ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কালের কড়চা

বাজেটের সরল, গরল ও জনগণের হিসাব নিকাশ

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
বাজেটের সরল, গরল ও জনগণের হিসাব নিকাশ

গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেট নিয়ে নানা রকমের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন আঙিকে বাজেট বিশ্লেষণ করছেন। এই সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র ৭ মাসের মতো। সংবিধান অনুসারে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন অর্থ বছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা বেশি হবে- এটাই স্বাভাবিক। বাজেট নিয়ে আলোচনার সংস্কৃতি পুরোনো। সরকারি দল এটাকে জনবান্ধব বাজেট বলছে, শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের বাজেট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে রাজপথের বিরোধীদলগুলো বলছেন, গরিব মারার বাজেট। বিএনপি নেতা সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তার দলের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘বাজেট সরকারি নাকি আই.এম.এফ দিয়েছে।’ বাজেটে সর্বাত্মকভাবে করারোপের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেছেন, বাজেটের আকার বাড়ছে ঋণের ওপর দাঁড়িয়ে এবং তা করা হচ্ছে সরকারের লুটপাটের সুবিধার জন্যে। এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে গত ৭ বছরে ৫২ শতাংশ ঋণ বেড়েছে। দেশের ভেতর ব্যাংকগুলো থেকে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের বাইরে থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়া হচ্ছে, এই ঋণের ভার আগামী প্রজন্মকে নিতে হবে। আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর এ সব কথা বিএনপির কথা।

আবার সংসদে বিরোধীদলের উপনেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাজেটে কল্যাণমুখী কিছু নেই। সিপিবি এক বিবৃতিতে বলেছে, দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্তির কিছু নেই। গণসংহতি বলেছে- সংকট মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা নেই। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এর চেয়ে বড় গোঁজামিল আর হতে পারে না। অর্থাৎ বাজেটকে গোঁজামিলের বাজেট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বাজেট নিয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। এখন প্রশ্ন জাগে মনে বাজেটের প্রশংসাকারী ও বদনামকারী অর্থনীতিবিদরা কী অর্থনীতির আলাদা আলাদা বই পড়েছেন? এর উত্তর জানা নেই। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি বিএনপি, জাতীয়পার্টি বা অন্য যে কোনো দল ক্ষমতায় থেকে হুবহু একই রকম, একই আকারের বাজেট ঘোষণা করত, তবে আওয়ামী লীগ তীব্র সমালোচনা করত বাজেটের বিরুদ্ধে, রাজপথে মিছিল বেড় করত। বিএনপি বাজেট নিয়ে গদগদ করত- এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। যুগ যুগ ধরে জনগণ এটাই দেখে আসছে- সরকারি দল যেটা ভালো বলে বিরোধীদল সেটাকে খারাপ বলবে। কেতাবী অর্থনীতিবদদের অবস্থানও সুবিধা অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে। যা হোক, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো অর্থনীতিবিদ নই। তাই রাষ্ট্রীয় বাজেট নিয়ে আমার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। রাষ্ট্রের আমজনতাও বাজেট নিয়ে শঙ্কিত, চিন্তিত, বা উচ্ছসিতও নয়। খেটে খাওয়া মানুষগুলো নিজের সংসারের বাজেট নিয়ে চিন্তিত থাকে। সংসার চালাতে যেমন বাজেট থাকে রাষ্ট্রের বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। শুধু আকারে ছোট বড়। বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে গোটা বিশ্বের মানুষই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছে না। প্রতি বছর বাজেট ঘোষণা হলেই প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে যায়, যে পণ্যটির দাম কমার কথা সেটির দামও কমেন না বিক্রেতা বা দোকানির সাফ কথা বাজেটে বেড়েছে। কাজেই আমজনতার বাজেট ভাবনা হচ্ছে, কোনটির দাম কমল আর কোনটি বাড়ল, নিজের সংসারের হেসেল তো সরকার টানবে না?

নিজেকেই টানতে হবে। একজন সংসার কর্তা চিন্তা করেন সংসারের কোন জিনিসটা বেশি প্রয়োজন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেই প্রয়োজনটাই আগে মেটাতে চেষ্টা করেন। কোথা থেকে টাকা অর্জিত হবে, কীভাবে তা ব্যয় হবে, সেটাই বাজেটের মূল লক্ষ্য সরকার ঠিক সেভাবেই চিন্তা করে।

বিগত বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে কোভিড-১৯-এর আঘাতে বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটাই তছনছ হয়ে যায়। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াবার অব্যাহত চেষ্টা সব দেশেই করেছে, কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে কেউ কেউ পারেনি। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিশ্ব সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে এর মধ্যেই আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধের প্রভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতেই একটা বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়, সে চাপ এখনও অব্যাহত আছে। এমনি সঙ্কটকালে বাংলাদেশের বাজেট ঘোষণা হয়েছে। অনেকে অর্থনীতি বুঝুক আর না বুঝুক বাজেট নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলছে। আসলে এটা আমাদের সংস্কৃতিরই একটা অংশ। সমালোচনা হতেই পারে তা হওয়া উচিৎ গঠনমূলক। দেশে ক্রমাগত মূল্য স্ফীতি বাড়ছে ডলার সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। বাজেটে এ সব বিষয়গুরো ভাবা উচিত ছিল।

বাজেটের বরাদ্দে যে সব উৎস থেকে টাকার জোগান দেয়া হবে তা স্পষ্ট করার পরও সম্প্রসারণমূলক এই বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতির পরিমাণ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে (এডিপি) বরাদ্দের কাছাকাছি। এডিপি বিশাল, ঘাটতিও বিশাল। যেহেতু বর্তমানে আমাদের পর্যাপ্ত ডলার মজুদ নেই তাই এডিপির বরাদ্দও কমিয়ে আনা উচিত ছিল।

বাজেটে দেশীয় শিল্প যেমন লিফট, বাইসাইকেলসহ কয়েকটি খাতকে সুরক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এটি ইতিবাচক দিক। এতে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে এবং দেশীয় শিল্পের বিকাশ ঘটবে। সর্বজনীন পেনশনের ঘোষণাটিও উৎসাহব্যঞ্জক। পেনশন প্রাপ্তিতে সাধারণ মানুষের খাতে ভোগান্তি না হয় সেদিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। ব্যক্তিশ্রেণিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়েছে এবারের বাজেটে। গত বাজেটে ছিল ৩ লাখ টাকা এবার সাড়ে ৩ লাখ। চলমান মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে এটা একটা ভালো দিক। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় শেয়ার বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। প্রতি বছরই বক্তৃতায় এ বিষয়ে কিছু থাকে। উল্লেখ্য, দেশের শেয়ার বাজারে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী রয়েছে। এ পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী অনেকেই সর্বস্ব হারিয়েছে। শেয়ার বাজারের চিহ্নিত লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। বর্তমানে শেয়ার বাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে কিছু না থাকায় হতাশ হয়েছে বিনিয়োগকারীরা। এমনিতেই হাজার হাজার বিনিয়োগকারী শেয়ার বাজার থেকে সরে গেছে আগামীতে আরও সরে যাবে। তখন পুঁজি বাজারে এর একটা প্রভাব পড়বে। তবে প্রস্তাবিত বর্তমান বাজেটে পুঁজি বাজার সংশ্লিষ্ট কোন খাতে সরসারি কর বাড়ানোর কথা বলা হয়নি।

অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী এ বাজেট সর্বজনীন বাজেট। ধনী-গরিব সব মানুষের কল্যাণের বাজেট। বিশ্ব খুব কঠিন সময় পার করছে। অর্থনীতিতে অনেক দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেও বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। বাজেটে কোনো বিষয়ে সমস্যা তৈরি হলে তা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। এটা ফিক্সড কোনো বিষয় না। বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র্য দূর হয়ে যাক এ প্রত্যাশা সবার। কাজেই সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে সবাইকে কাজ করতে হবে। বাজেটে যা ঘোষণা করা হয়েছে তা যদি যথাযথ বাস্তবায়ন হয় তবে সবার জন্যই ভালো হবে। বাজেট বাস্তবায়নে সব মানুষের ঐক্য দরকার। জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এই কঠিন সময়ে জাতীয় ঐক্যের নীতি কী হবে তা ঠিক করতে হবে। তবেই মুক্তি আসবে সব ক্ষেত্রে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত