দেশে এখন অনেক সমস্যা। যদি জানতে চান- কী সমস্যা? তাহলে হাতের আঙুলের গিঁট গুণেগুণে উত্তর দেয়া লাগবে। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না। তবে, জানিয়ে রাখি, সামনেই জাতীয় নিবাঁচন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে টানাটানি, বিদেশি নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতি, নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ইত্যাদি সমস্যা অন্যতম। এই সমস্যাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি ব্যাধি। যাকে এখনও মরণব্যাধি বলতে চাই না, বলতে চাই- দারুণব্যাধি। ব্যাধিটির নাম ডেঙ্গুজ্বর। কিছুদিন যাবত প্রতিনিয়ত মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গুজ্বরের পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে গুণিতক হারে। ইদানীং ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ধারণ করছে ভয়াবহ আকার। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগিতে ভরছে হাসপাতাল।
স্টাডি বলে, সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম। ওই সময়টিতে বর্ষাকাল শুরু। তখন বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোরব পর্যন্ত। তাই পুরো সময়টিকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেয়া হয়। সে হিসাবে এডিস মশার প্রজনন এখনও শুরু হয়নি। আবার এবারে বৃষ্টিপাতও তুলনামূলক হারে কম। কিন্তু এতদসত্তেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মারফত জানা গেছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ৮০ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শনিবার (২৭ মে) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন ৮০ জন ডেঙ্গুরোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। নতুন ভর্তি রোগীর ৭৩ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এবং সাতজন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৩১ মে পর্যন্ত মোট ২০২ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৭৭ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ২৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৭০৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকায় ১ হাজার ১১৯ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৫৮৫ জন রয়েছেন। একই সময়ে দেশে মোট ছাড়প্রাপ্ত ডেঙ্গু রোগী ১ হাজার ৪৮৯ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগী ৯৩৩ জন এবং ঢাকার বাইরে সারাদেশে ৫৫৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি এবং এবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২৮১ জন মারা গিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো, শহরে জলাবদ্ধতা বেশি, পরিবেশ দূষণ বেশি, জনসংখ্যা বেশি তাই শহরে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বেশি হওয়ারই কথা; কিন্তু ইদানীংকালে গ্রামেও এর পরিমাণ বাড়ছে কেন? এ প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে গেছে। নগরায়ন ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামেও। তাই এখন ডেঙ্গুর কাল বদলে যাচ্ছে। মৌসুম শুরুর আগে আক্রান্তের হারই তার প্রমাণ। সুতরাং তার জন্য এখন রাজধানী ও বিভাগীয় শহর ছাড়াও ডেঙ্গুনির্মুলের কার্যক্রম গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া বিকল্প কিছু নেই। আবার ডেঙ্গু রোগের বিস্তার হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কীটতত্ত্বববিদরা বলছেন, এখন এমন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি রয়েছে। রাস্তা উঁচু করার ফলে নিচু হয়ে যাওয়া বাসাবাড়ির জমা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত কীটনাশক দিয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক অ্যাডিস মশা মরছে না। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত রাজধানীর ৮টি এলাকায় অ্যাডিস মশা নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, ঢাকা শহরের অ্যাডিস মশা ওষুধ প্রতিরোধী। বর্তমান ওষুধে তারা মরে না। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় জুন-জুলাই ডেঙ্গু জীবাণুবাহী অ্যাডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমে যায়। জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে অ্যাডিস মশার জন্ম হয়। রাজধানীর মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের ৯ শতাধিক কর্মী প্রতিদিন কাজ করছেন। এতে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত আটজন করে শ্রমিক কাজ করার কথা। কিন্তু এলাকায় এসব লোকের দেখা পান না নগরবাসী। নগরবাসী দাবি, ওই দুই মাসেই নয়, এবার বছর জুড়েই মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ তারা। এমন অবস্থা যে, দিনের বেলায়ও বাসা-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, অফিস সব জায়গায় মশার উৎপাত। অথচ বর্ষা শুরুর আগে মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি সিটি করপোরেশন। মশক নিধনের কাজে নিয়োজিত কর্মীদের দেখা যায় কালেভদ্রে। কোনো বড়ো প্রোগ্রাম না থাকলে মশক নিধনের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। মাঠ পর্যায়ে মশক নিধনের সঙ্গে যুক্ত সিটি করপোরেশনের সদস্যরাও স্বীকার করেছেন, ওষুধে মশা মরে না, কথা সত্য। সত্য যদি তাই হয়, তাহলে আমাদের রাজধানী শতধাবিভক্ত করে একাধিক নগর পিতা করে কী লাভটা হলো।
বৃহত্তর ঢাকার আনাচে-কানাচের মানুষ যেন সব ধরনের সেবা পায় তার জন্য ঢাকাকে দুটি সিটিতে ভাগ করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু অতিব দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে, নগরের মানুষ আজও সে ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত যে সেবা তাদের পাওয়া উচিত। ডেঙ্গুই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিবছরই ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করে- সবাই জানে। জানে সিটি করপোরেশনের লোকজনও। কিন্তু বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। কথাকথিত মশা মারার যে ওষুধ স্প্রে করা হয়, তা দ্বারা মশা মরে না তা আপনারা আগেই শুনেছেন। তাই নগরবাসীর দাবি- ডেঙ্গুতে যারা এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়ে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তাদের সঠিক চিকিৎসার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক। সেইসঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া সময়ের দাবি। তদুপরি, এই ডেঙ্গু এ বছরই তার রোগ ছড়াবে আগামী বছর আর ছড়াবে না, যেহেতু এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়ার জন্য দেশবাসী আশা প্রকাশ করে।