সারা দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এ বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৮৪৩ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ১৮ জনের। রোগীর সংখ্যা গতবারের তুলনায় ছয় গুণ। সরকারের পক্ষ থেকে হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ডেঙ্গু এখন সিজনাল নেই, সারা বছরই হচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হলে এটা বাড়ছে। গত বছর ডেঙ্গু প্রকোপ জুন মাস থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছর মে মাস থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিগত বছরগুলোর চেয়ে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও রেকর্ড ভাঙতে পারে। দিন যতই যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ততই ভয়াবহ হচ্ছে। ডেঙ্গু এখন আর বর্ষা মৌসুমের আতঙ্ক নয়। ফলে এর ভয়াবহতা বাড়ছে। এটি মোকাবিলায় দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ব্যাপকভাবে সচেতন হতে হবে। গত বছরের ৩০ মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু না হলেও আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩২০ জন। ২০১৯ সালে দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সে বছর মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা যান দুইজন। গত বছর ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। তখনও মে মাস পর্যন্ত কোনো মৃত্যু ছিল না। অথচ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে এবারের ভয়াবহতা। শুধু মে মাসেই আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮৭০ জন। দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে প্রকোপটা ঢাকায় বেশি। দেশে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। তাতে একদিকে ডেঙ্গু যেমন ভয়ংকর হয়ে উঠছে, তেমনি ‘শহুরে রোগ’ ডেঙ্গু শহর ছাড়িয়ে ঝুঁকি বাড়িয়েছে দেশজুড়ে।
ডেঙ্গু সচেতনতায় সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে আড়াই হাজার নার্স-ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম এবং সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া হচ্ছে। প্রচার প্রচারণার জন্য ব্যানার-পোস্টার তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সভা করা হয়েছে। যদি কোনো জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়, তার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে। এছাড়াও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় সরকারের পক্ষ হতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাসপাতাল যাতে প্রস্তুত থাকে, চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু সচেতনতায় শহরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। আগাম বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এ মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা বেশি। সেদিক থেকে প্রাক-মৌসুমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। এদিকে ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের একটি ভুল ধারণা রয়েছে। ডেঙ্গু হলেই আমরা পেটলেটের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। কিন্তু ডেঙ্গু আসলে পেটলেট ডিজঅর্ডার নয়, এক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণ হতে পারে প্লাজমা লিকেজ। এককথায় বলতে গেলে ডেঙ্গুতে পেটলেটের কোনো ভূমিকা নেই। পেটলেটের চেয়ে ডেঙ্গু রোগীর জন্য বেশি দরকার ফ্লুইড। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যেখানে ঘনবসতি, সেখানে মশার উপদ্রব বেশি। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের নির্দেশে সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার জন্য লোকবল, লজিস্টিকস, জায়গা তৈরি রাখার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। ডেঙ্গুর অবাধ বিচরণ রাজধানী ছাপিয়ে এখন দেশের জেলাগুলোতে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ডেঙ্গুর বাহক এডিস। প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে রোগী। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অভিযোগ, মশা নিধনে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। অনীহার কারণে রোগীরা মশারি টানাচ্ছেন না। তবে ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ডেঙ্গুর চারটি ধরন আছে: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। ২০১৮ সালের পর ডেঙ্গুর ডেন-১ ধরনে মানুষের আক্রান্ত হতে দেখা যায়নি। ২০২১ সালে সব মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল ডেন-৩ ধরনে। এ বছর ডেন-৪ ধরনের প্রকোপ বেশি। আবার ডেন-৩ ও ডেন-১ ধরনেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ডেঙ্গুর তিনটি ধরন দেশে এখন সক্রিয়। এটি ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। ২০০০ সালে দেশে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। প্রতিবছরই মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগে থাকে। মানুষকে সচেতন থাকতে হবে করতে হবে, নিজের বাড়িতে এডিস মশা না থাকার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আর জ্বরে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। যেভাবে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। বাড়তে পারে মৃত্যুর সংখ্যা। সচেতনতার অভাবেই প্রতি বছর এভাবে ডেঙ্গু হানা দেয়। শিশুদের এই সময়ে হাত-পা ঢাকা জামা-কাপড় পরানো উচিত। তারা দিনে ঘুমালে মশারি টানিয়ে দেয়া উচিত। ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা দিনে কামড়ায়। তখন অধিকাংশ শিশু স্কুলে থাকে। স্কুল থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আর জ্বর হলে নিজের চিকিৎসা নিজে না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরার্শ নিতে হবে। বাংলাদেশে ২৯ প্রজাতির মশা থাকলেও এডিস প্রজাতির মশা দ্বারা সংক্রমিত ডেঙ্গু এ বছর মহামারি আকার ধারণ করেছে। এডিস মশা হলো ডেঙ্গু জ্বরের বাহক। অসচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের কারনেও ছড়ায় ডেঙ্গু ভাইরাস। এই ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর। এডিস ইজিপ্টাই নামক এক ধরনের মশা এ ভাইরাস বহন করে। এ মশা কাউকে কামড়ালে তিনি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রকট। বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে সাধারণত এ জ্বর হয় না বললেই চলে। সাধারণত শহর, নগর ও বন্দর এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি। কারণ ওইসব অঞ্চলের অভিজাত এলাকার নালা-নর্দমা ও বড় বড় দালান কোঠা ও স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার প্রকোপ বেশি থাকে। তবে বস্তি বা গ্রামের বাসিন্দাদেরও অপরিচ্ছন্নতার কারণে ঝুঁকি থেকেই যায়। এদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস শিশুদের বেশি আক্রমণ করে। ফলে তীব্র প্রকোপে শিশুরা মৃত্যু যন্ত্রনা ভোগ করে। আবার অনেকেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। তবে একটু সচেতন হলেই ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে নিজেকে ও শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব। নিজেকে যতই বন্দি রাখিই না কেন, এডিস মশা কিন্তু উড়ে উড়ে আমাদের ঘরে চলে আসতে পারে। যেহেতু বাসাবাড়ির জমানো পানিতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে তাই সম্প্রতি সেসব বাসায় অভিযান চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তাই যাদের বাসায় পাওয়া যাচ্ছে, এডিসের লার্ভা তাদের জরিমানাও করা হচ্ছে। করোনার মতো মানুষের কাছে এখন আতঙ্ক ডেঙ্গু। যেহেতু এডিস মশাই এর একমাত্র বাহক সেহেতু এই মশার আবাস ও প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করতে পারলেই শুধু আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু মশাই এই রোগের একমাত্র বাহক, সুতরাং মশার আবাস ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে পারলেই এডিস নির্বংশ হবে সমূলে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় তাই এডিস মশার বংশ নাশ। তাই বসতবাড়ির এ রকম আবদ্ধ জলাধার ধ্বংস করতে হবে। ফ্রিজের বা এসির পানি দুই দিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে। বাসার বারান্দায়, টেরিসে বা কার্নিশে খোলা টব থাকলে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। রাস্তার আশপাশের খানাখন্দ ভরাট করে ফেলতে হবে। কিন্তু অনেক নগরবাসী সচেতন হলেও এখনও অনেকে আছেন যারা সচেতন হচ্ছেন না। তারা তাদের বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখছেন না। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একসঙ্গে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও মশামুক্ত করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শহর আমাদের পরিষ্কার রাখতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি করপোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে ঠিক তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও কম নেই। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহতায় সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে আসতে হবে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের দিকে না তাকিয়ে পাড়া-মহল্লায় তরুণরা দল বেঁধে নিজেরাই নেমে পড়তে হবে, আমাদের নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সে জন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। জ্বর হলে দুটি টেস্টই করতে হবে। তারপর ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। চোখ-কান খোলা রাখুন, বাসার আশপাশে যাতে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে। আমরা সবাই জানি, এডিস মশা বংশবিস্তার করে পরিষ্কার পানিতে। তাই বাসার, বারান্দার, ছাদের টবে যেন পানি জমতে না পারে। রাস্তায় যেন আমরা ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার বা পানি জমার মতো কিছু ফেলে না রাখি। বাসার চারপাশ পরিচ্ছন্নতা রাখতে হবে। কোরবানির পশুর বর্জ্যও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে। সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাহলে হয়তো রক্ষা পাওয়া যাবে। তা না হলে ডেঙ্গু এবার মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।