ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

৬ দফা দিবস

অধিকারের উৎস ধারায় ৬ দফা

সামছুল আলম দুদু এমপি, রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য
অধিকারের উৎস ধারায় ৬ দফা

দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়। সে আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের জাতির পিতা। বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে যার উজ্জ্বলতম অবস্থান তিনি আমাদের গৌরব, ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তার মহাকীর্তির অন্যতম অনুষজ্ঞ ৬ দফা। ১৯৬৬ সালের ঘোষিত ৬ দফার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন গতিলাভ করেছিল। ঐতিহাসিক এ সত্যকে প্রতি বছরই ৭ জুন তুলে ধরতে হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কেননা­ এই ৭ জুন বাঙালির মুক্তির সনদ ঘোষিত হয়েছিল। তাই ৭ জুন ৬ দফা দিবস হিসেবে চিহ্নিত। আমরা স্বাধীনতাকামী বাঙালি এই দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকি। কিন্তু একটা চিহ্নিত গোষ্ঠী এই দিবস পালন করে না এবং এর গুরুত্ব বোঝার প্রয়োজনও বোধ করে না। অথচ ৬ দফার ওপর ভর করেই বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এর উৎস ধারায় বাঙালির মুক্তির বীজমন্ত্র নিহিত ছিল।

বলা অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা এ উপমহাদেশের বাঙালিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোষণের জালে আবদ্ধ ছিলাম। রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত প্রজাসর্বস্ব জাতি হিসেবে বিবেচিত ছিলাম। ব্রিটিশ রাজের কূটচালে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। বিভাজিত জাতি হিসেবে আমরা অন্ধগলির দিকে ধাবিত হচ্ছিলাম। ব্রিটিশ শাসনের আসান হলো। অনেকটা রক্তপাতহীন ভাবেই ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো দুটি রাষ্ট্র জন্মের মধ্য দিয়ে। এর একটি পাকিস্তান অন্যটি নিখিল ভারত। পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান। যেটি আজকের বাংলাদেশ। বাঙালি ব্রিটিশ থেকে মুক্তি পেল বটে; কিন্তু পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকের শোষণের মুখে পতিত হলো এ জাতি। পাকিস্তানের ঊষালগ্ন থেকেই কথিত জাতির জনক কায়েদে-আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দেশটির গভর্নর জেনারেল হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে বহাল থাকেন। গুজরাটি বংশদ্ভূত আইনজীবী রাজনীতিবিদ ১৯১৩ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানে প্রথমেই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে। বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানেও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। বাঙালিরা এর বিরোধিতা করে। আন্দোলনের সূত্রপাত এখান থেকেই। জিন্নাহ ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্তির পর বাঙালি ভেবেছিল তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন বৈষম্য বাঙালি জাতিকে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়। ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ঐক্যবদ্ধ করেন জাতিকে। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। তরুণ মুজিবকে তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এই ৬ দফার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য হবে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আদলে ৬ দফা কর্মসূচি প্রণীত হয়। শেখ মুজিব জানতেন ৬ দফা পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী কখনো মেনে নেবে না। তাই ৬ দফাই এক দফার আন্দোলনে রূপান্তর হবে। আর সেটি হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপি তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। এদিন পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে জনগণ অভূতপূর্ব সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। এদিন টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি নিহত হন। রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার রাজপথ। জনগণ ফুঁসে ওঠে। সেই রক্তের শপথে স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্রতর হয়। ৬ দফার মধ্যেই আমাদের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। বাঙালি জাতির জন্য এই ৬ দফা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে এর মূল্য অপরিসীম। ৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়। ৬ দফা ঘোষণার মাধ্যমেই শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ১ মার্চ ১৯৬৬-তে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে বসেই তিনি ঠিকঠাক মতো বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আন্দোলনে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সীমাহীন ত্যাগের ইতিহাস স্থাপন করেন। যৌবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি জেলে কাটিয়েছেন। আফ্রিকান নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন আফ্রিকান জাতির মুক্তির জন্য জেল খেটেছেন। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে আপস করেননি। তিনি ইচ্ছা করলে রাজনৈতিক জীবনে ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থকে উপেক্ষা করে গোটা বাঙালি জাতির স্বার্থ উদ্ধারে মনোনিবেশ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। একটা জাতি ও দেশকে কীভাবে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত সফলতার দিকে নিয়ে যেতে হয়, তা তিনি জানতেন বলেই ৬ দফার মতো কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন, যে ৬ দফা বাঙালি জাতিকে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে। ৬ দফার উৎস ধারায় মুক্তির চেতনা নিহিত ছিল। স্বাধীন বাংলার আকাশে তাই ৬ দফা ৬টি ধ্রুবতারার শামিল। ইতিহাসের পাতায় যুগ-যুগান্তরে দেদীপ্যমান থাকবে ৬ দফা। আমাদের জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ৭ জুন। ৬ দফার দাবি আদায়ের আন্দোলনে যারা রাজপথে আত্মাহুতি দিয়েছেন, সেই শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাদের রক্তদান বৃথা যায়নি। দেশ ও জাতির মুক্তির আন্দোলনে দান করা রক্ত কখনো বৃথা যায় না। রক্তের ঋণ শোধ করতে হবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত