প্লাস্টিক বর্জ্যে বিপন্ন প্রাণ-প্রকৃতি
সমাধানে ঐতিহ্যমুখী হতে হবে
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মাত্র দুই দশকে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহারে আমরা এমনভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, এর ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকটি আমরা ভুলে গেছি। সত্যি বলতে কী, আমরা বেপরোয়াভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। এর বিপুল ক্ষতির কথা জেনেও আমরা ক্ষান্ত হচ্ছি না। কোথাও সড়কের ওপর পড়ে আছে প্লাস্টিকের বোতল, কোথাও ভাসছে নর্দমায়। নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব বাজার। আইন থাকলেও বন্ধ হয়নি প্লাস্টিকের ব্যবহার। উল্টো ব্যবহার বেড়েছে। অধিকন্তু এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রয়েছে পরিবেশবান্ধব পদ্ধটির ঘাটতি। ফলে পড়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য নষ্ট করছে মাটির গঠন; আর খাল-নালা-নদীতে ফেলা প্লাস্টিক যাচ্ছে সাগর পর্যন্ত, যা পানিকে বিষিয়ে তুলছে। মাছের পেটেও যাচ্ছে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ ও প্রকৃতি। তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টনের মতো রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হয়। বাকি সব পরিবেশে পড়ে থাকে। ফলে সবুজ, নদীর টলটল জল কিংবা বাতাসে প্রশান্তির ছোঁয়া এখন চাইলেই মানুষ পায় না। প্লাস্টিক বর্জ্যে বিপন্ন আজ প্রাণ-প্রকৃতি। আর এর কারণ হিসেবে দায়ী কিন্তু আমরা- মানুষ! এটি একটি অত্মবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডও বটে।
আক্ষরিক অর্থেই আমরা বসবাসের অযোগ্য করে তুলছি প্রাণ-প্রকৃতিকে। যে সবুজের সমারোহে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে, মাঠে-ঘাটে শীতল পরশ নিয়ে পূর্বতনরা বেঁচে ছিলেন, অথচ কৃত্রিমতায় ঠাসা জীবনে পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা রেখে যাচ্ছি এক বিপন্ন জলবায়ুর পৃথিবীতে। পরিবেশ দূষণে প্লাস্টিক এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, এবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে এটি উঠে এসেছে- সলিউশনস টু প্লাস্টিক পলুশন। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা যেসব পণ্য ব্যবহার করি, তার বেশির ভাগ সামগ্রীই প্লাস্টিকের তৈরি। প্লাস্টিক হচ্ছে কৃত্রিমভাবে তৈরি পলিমার, যা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক উপায়ে তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক সাধারণভাবে নমনীয়, যা সহজে বাঁকা করা যায়, ক্ষয়রোধী, দীর্ঘস্থায়ী ও কম দামি। আর এসব ক্ষতিকর পচনরোধী বর্জ্য পরিবেশে ৪০০ থেকে ১ হাজার বছর পর্যন্ত থাকতে পারে এবং তা মাইক্রো, ন্যানো প্লাস্টিকের কণাসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসরণ করে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যে ভয়ংকর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অর্থাৎ এই সহজলভ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করে আমরা আমাদের পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছি। এটি একটি একটি বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি (ইউএনইপি) মনে করে, যুদ্ধ, সংঘাত, মহামারি ও দুর্ভিক্ষের মতোই পরিবেশ বিপর্যয় বিশ্বের অন্যতম প্রধান বিপদ। আগামী দিনগুলোয় পরিবেশবিষয়ক ইস্যুগুলোই পৃথিবীর সামনে প্রধান হয়ে দেখা দেবে। সংগত কারণেই প্লাস্টিকের ভয়াবহতা থেকে মুক্তির অন্বেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
যেখানে আইনি বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে, সেখানে কীভাবে প্লাস্টিকের বেপরোয়া ব্যবহার বাড়ছে, তা বিস্ময়কর। এখানে তদারকি ও নজরদারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতার বিষয়টি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধে আমরা বিভিন্ন পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি শুনে থাকি। এই নিয়ে সমাজে এক ধরনের সচেতনতাও তৈরি হয়েছে। তার পরও কেন প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার কমছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়। বিশেষ করে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে বড় বড় শপিং মলে যে পরিমাণ পলিথিন ব্যবহার হয়, তার বিকল্প করা গেলেও অনেকটা স্বস্তি ফিরবে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ঐতিহ্যের কাছে ফিরে গেলে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। দুই যুগ আগেও ঘরে ঘরে কাঁসার থালায় খাওয়া-দাওয়া হতো। কাঁসা কিংবা মাটির কলসে পানি থাকত। অর্থাৎ আমরা যেমন ছিলাম, তেমন জীবনে ফিরে গেলেই তো প্লাস্টিক নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। আমরা পলিথিনের পরিবর্তে ব্যাগ বা বহনের সামগ্রী হিসেবে পাটজাত পণ্যকে ব্যবহার করতে পারি। সর্বোপরি, নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে।