ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পর্যালোচনা

মুডি’স রেটিংয়ে অবনমন : ব্যাংকিং ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব এবং সতর্কতা

এম এ মাসুম, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং বৈদেশিক বিনিময় বাণিজ্য অর্থায়ন বইয়ের লেখক
মুডি’স রেটিংয়ে অবনমন : ব্যাংকিং ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব এবং সতর্কতা

সম্প্রতি দেশের সাতটি বেসরকারি ব্যাংককে ‘নেতিবাচক’ রেটিং দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণমান প্রদানকারী সংস্থা মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস। এর মধ্যে ছয়টির ‘দীর্ঘমেয়াদি ডিপোজিট’ ও ‘ইস্যুয়ার রেটিং’ অবনমন এবং আরেকটি ব্যাংকের প্রথম রেটিং করা হয়েছে। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমানও কমিয়ে দিয়েছে মুডি’স। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন উঁচু মাত্রার দুর্বলতা ও তারল্যের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে চলমান সংকটের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান একধাপ কমিয়ে বিএ৩ থেকে বি১-এ নামিয়েছে। উল্লেখ্য, মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইন্টিগ্রেটেড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ফার্ম বা সমন্বিত ঝুঁকি মূল্যায়ন ও ঋণমান নির্ণয়কারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এটি ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি মূল্যায়ন ও ঋণমান নির্ণয়ের কাজ করে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে ১৩ হাজারের অধিক জনবল নিয়ে বিস্তৃত রয়েছে তাদের কার্যক্রম।

ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে এটা দেখায় যে- একটি দেশের, কোনো প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির সক্ষমতা কতটা আছে। যেমন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কোন দেশ যদি ঋণ নিতে চায়, তখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই রেটিংয়ের ভিত্তিতে বুঝতে পারে যে, দেশটি সময়মতো ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কতটা আছে। ক্রেডিট রেটিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সক্ষমতা, অতীত ইতিহাসের ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়। সেই রেটিং থেকে ক্রেতারা বা ঋণদাতা অথবা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পারে, তাদের সঙ্গে লেনদেন করা কতটা নিরাপদ। তারা ঋণ পরিশোধে কতটা সক্ষম। ওই দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে কতটা ঋণ দেয়া নিরাপদ হবে।

বিভিন্ন ক্যাটেগরির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাগ করা হয়ে থাকে। এটা একপ্রকার মার্কিং সিস্টেম। যেমন- ‘এএএ’ ‘বিএ’ ‘সি’ ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানের মূলধন, আমানত, দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের খাত, ঋণের খাত, ঋণ পরিশোধের হার ইত্যাদি সূচক বিবেচনায় নিয়ে এটি নির্ধারণ করা হয়। ‘এএএ’ মানে হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক রেকর্ড খুব ভালো এবং ঋণ ফেরত দেয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ‘বিএ’ মানে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে রেটিং ‘সি’ মানে হচ্ছে সেখানে আসল ও মুনাফা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের ভেতরে ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন করা কতটা নিরাপদ, এ ক্রেডিট রেটিং দিয়ে সেটা নিরূপণ করা হয়ে থাকে। সাধারণত এ রেটিং এজেন্সিগুলোর আন্তর্জাতিক একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কাজেই তারা যে রেটিংটা দেয়, সেটা ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো সেটার ভিত্তিতে শর্তাবলী এবং সুদের হার নির্ধারণ করে। কাজেই রেটিং ভালো হলে যেমন সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ পাওয়া যায়। আবার রেটিং খারাপ হলে ঋণদাতারা সেটি ঝুঁকি হিসেবে দেখে। তখন তারা কড়া শর্ত এবং বেশি সুদ আরোপ করে। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়েই চায় যাতে, তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হয়।

আর্থিক খাতের একাধিক সূচক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্রেডিট রেটিং করা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিং করে থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম এই মোডি’স। সাধারণত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে, অনেক সময় নির্দিষ্ট ফিয়ের বিনিময়ে তারা রেটিং করে থাকে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চায় যে, তাদের ক্রেডিট রেটিং ভালো হোক। কারণ এর ভিত্তিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিনিয়োগ পাওয়া, এলসি খোলা ইত্যাদিকে ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দেশীয় ব্যাংকের এলসি গ্রহণ করতে সম্মত হয়নি কিছু ব্যাংক। যখন কেউ ঋণ নিয়ে থাকে, সেটা ঠিকভাবে পরিশোধ করেছেন কিনা, ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনে বকেয়া রয়েছে কিনা, খেলাপি হয়েছেন কিনা, ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে জানতে পারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর ভিত্তিতে তারা ঋণ দেয়া না দেয়া, কতটা ঋণ মঞ্জুর করা হবে ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

সেখানে বিনিয়োগের অবস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিষয়ও বিবেচনায় রাখা হয়। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ, বাণিজ্যিক লেনদেন পরিশোধের সক্ষমতা কতটা আছে, সেটা দেখা হয়। ক্রেডিট রেটিং যদি ভালো হয়, তখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা পেতে হলে সহজ শর্তে তা পেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা সেসব দেশে বিনিয়োগে উৎসাহী হন। কিন্তু রেটিং ভালো না হলে সেটা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় রেটিং খারাপ হলে বাণিজ্যিকভাবে অন্য দেশের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি সেই দেশের ব্যবসায়ী বা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করতে দ্বিধায় ভোগে।

সম্প্রতি মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। মুডি’সের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, চলমান সংকটের সময়টিতে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাহ্যিক দুর্বলতা ও তারল্য ঝুঁকি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার বিষয়টি সামনে এসেছে। বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট প্রোফাইল ‘বি১’ রেটিংয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিছুটা শিথিল হওয়া সত্ত্বেও চলমান ডলার ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়টি থেকে বাংলাদেশের বহিস্থ অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটছে। দেখা দিচ্ছে জ্বালানি সংকট। সরকার এখনো আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগটি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি এবং একাধিক বিনিময় হার ও সুদহারের সীমার মতো অপ্রচলিত উদ্যোগ বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি অর্থনীতির আকারের তুলনায় রাজস্ব আহরণ অত্যন্ত কম। বিষয়টিতে সরকারের নীতিগত সক্ষমতা ব্যাহত হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্বল্পমেয়াদের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। একই সঙ্গে দুর্বল হচ্ছে সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা।

মুডি’স মনে করছে, বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতাকে দুর্বল করবে ঋণের পরিমাণ। এছাড়া আর্থিক সংস্কার বাস্তবায়ন হতেও কয়েক বছর সময় লাগবে। একই সঙ্গে মুডি’স বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রাকে ‘বিএ১’ থেকে ‘বিএ২’ এবং বৈদেশিক মুদ্রার সীমাকে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’-এ নামিয়ে এনেছে। সভরেন রেটিংয়ের চেয়ে স্থানীয় মুদ্রার সীমা দুই ধাপ ওপরে রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার সীমার চেয়ে দুই ধাপ নিচে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সীমা। মুডি’সের মূল্যায়ন অনুসারে, বাংলাদেশের বাহ্যিক অবস্থান অতিমারীর আগের সময়ের তুলনায় কাঠামোগতভাবে দুর্বল থাকবে। তবে বিদেশি অর্থায়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাবে বলে প্রত্যাশা করছে সংস্থাটি।

২০২৪ সালের জুনের শেষ নাগাদ রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারে বলে মনে করছে মুডি’স। তবে সেক্ষেত্রেও রিজার্ভ কোভিডপূর্ব পর্যায়ে যেতে ২ থেকে ৩ বছর লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০২১ সালের আগস্টে। তখন থেকে এ পর্যন্ত রিজার্ভ কমেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ২৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা দিয়ে ৩ দশমিক ৭ মাসের পণ্য ও সেবা আমদানি করা যাবে। ২০২১ সালের আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ৭ মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। আমদানিতে বিধিনিষেধ ও জ্বালানিতে কৃচ্ছ্রসাধন সত্ত্বেও এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন ও আমদানিতে বিধিনিষেধের পাশাপাশি স্থিতিশীল রপ্তানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে জ্বালানি পণ্যের দামের কারণে চলতি হিসাবের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে।

মুডি’সের পূর্বাভাস, বাংলাদেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ আগামী ২ থেকে ৩ বছর ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই থাকবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তমাফিক এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) বাদ দিয়ে হিসাব করা হলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমবে। মুডি’স মনে করছে বাংলাদেশের আমদানির সক্ষমতার অনুপাত ৩ মাসের আশপাশে স্থির থাকবে। সংস্থাটির এক্সটার্নাল ভালনারেবিলিটি ইন্ডিকেটর (ইভিআই) অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ আনুমানিক ২০ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ২ দশমিক ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। ধারাবাহিক নিম্ন রাজস্ব ও ক্রমবর্ধমান সুদ পরিশোধের কারণে আর্থিক অবস্থা বিশেষ করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা দুর্বল হবে। জ্বালানি, সার ও খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সরকারের ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের পরিমাণ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়াবে। অন্যদিকে আমদানিতে বিধিনিষেধের কারণে রাজস্ব আয় কমে গেছে। আর্থিক ঘাটতি আগামী ৫ বছরে জিডিপির ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশে থাকবে বলে মনে করছে মুডি’স। ২০২৬ অর্থবছর শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে জিডিপির ৪০ শতাংশে দাঁড়াবে, যা ২০২২ অর্থবছর শেষে জিডিপির ৩০ শতাংশের নিচে ছিল।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুডিস ঋণমান কমানোর ফলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ ও ঋণের সুদের হার বাড়বে। সুদের হার যদি আধা শতাংশও বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৭ হাজার কোটি থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, খরচ বেশি হলে বিদেশিরা এ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না।

মুডি’স বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের রেটিংয়ের আগেই অবনমন করেছিল। এখন সার্বিকভাবে দেশের রেটিং অবনমন করেছে। এর ফলে বিদেশি ঋণের সুদহার ও আনুষঙ্গিক ফি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি ঋণ নিয়ে দরকষাকষির সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসবে। কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরো বাড়তে পারে। আইএমএফের কর্মসূচি কিছু রাজস্ব সংহতিকরণ কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করলেও প্রশাসনিক ও দক্ষতায় ঘাটতির পাশাপাশি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দুর্বল ট্র্যাক রেকর্ডের কারণে মুডি’স মনে করছে রাজস্ব আদায় ও কর ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি থাকবে। আগামী ২ থেকে ৩ বছরে জিডিপি ও রাজস্বের অনুপাত পরিমিত হারে উন্নতি করলেও সেটি ১০ শতাংশের নিচে থাকবে এবং বর্তমানে তা ‘বি১’ রেটিংয়ের নিচে রয়েছে।

দেশের অবনমনের পর এবার দেশের সাতটি বেসরকারি ব্যাংককে ‘নেতিবাচক’ রেটিং দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণমান প্রদানকারী সংস্থা মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস। এর মধ্যে ছয়টির ‘দীর্ঘমেয়াদি ডিপোজিট’ ও ‘ইস্যুয়ার রেটিং’ অবনমন এবং আরেকটি ব্যাংকের প্রথম রেটিং করা হয়েছে, যা নেতিবাচক বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রেটিং কমানো ব্যাংকগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, এনসিসি ব্যাংক লিমিটেড ও প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। আর মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের রেটিং নিশ্চিত করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। মুডিস জানিয়েছে, সাত ব্যাংকের মধ্যে এনসিসি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের রেটিং বি-৩ থেকে বি-২ করা হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি আমানত ও ইস্যুয়ার রেটিং বি-৩ থেকে বি-২ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের রেটিং পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দিয়েছিল মুডি’স। এর আগে গত ডিসেম্বরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের মান কমিয়ে দেয় মুডিস। তখন এক বার্তায় তারা জানিয়েছিল, এসআইবিএলের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের মান বি-৩ থেকে নামিয়ে বি-২ করা হয়েছে এবং ব্যাংকটির বেসলাইন ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্ট (বিসিএ) বি-৩ থেকে নামিয়ে সিএএ-১ করা হয়। একই সঙ্গে এসআইবিএলের ঋণমানের পূর্বাভাসও পরিবর্তন করে। তখনই সাত ব্যাংকের ঋণমান পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দিয়েছিল মুডিস।

ব্যাংকাররা বলছেন, কোনো দেশের ঋণমান কমিয়ে দিলে সেই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণমানেও তার প্রভাব পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় বেসরকারি সাত ব্যাংকের ঋণমান কমানো হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন মুডি’স কর্তৃক দেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ার প্রভাবে এলসি কমিশন ও ফি বেড়ে যাবে। বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের সুদহারও বাড়বে। এতদিন সুদহার ও কমিশন কমানোর জন্য যে দরকষাকষির সুযোগ ছিল, সেটিও কমে যাবে। এখন বিদেশি ব্যাংকগুলো এলসি ও বিদেশি ঋণের মেয়াদ বাড়াতে চাইবে না।

কোনো ফ্যাক্টরগুলোর কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রেটিংয়ের আরও অবনমন কিংবা উন্নতি হতে পারে, সে বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়ে মুডি’স। সংস্থাটির মতে, সরকারের রাজস্ব সংস্কার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যা রাজস্ব আহরণ সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবে এবং এর ফলে ঋণ সক্ষমতা ও ফিসক্যাল স্পেস বাড়বে। মুডি’সের প্রত্যাশার চেয়েও বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া। তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতার বাইরে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে বস্তুগত উন্নতি, প্রধান অবকাঠামোগত উন্নতি, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দেবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল করতে বিদেশি বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশের রেটিংয়ে উন্নতি আনতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে মুডি’স-এর সতর্কবার্তার ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণগ্রহণের খরচ ও পুঁজিবাজারে প্রবেশের ক্ষমতা প্রভাবিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন। তিনি মনে করেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে মুডি’স এর দৃষ্টিভঙ্গি অবনমন হওয়ায় বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এর ফলে বাংলাদেশের সুনাম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং ব্যয়বহুল হবে, যার ফলে দাম বেড়ে যাবে।’

সিনিয়র ব্যাংকাররা মনে করেন, সংস্কারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাবের কারণে এ অবনমন ঘটেছে। ২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। তাছাড়া, দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রায়ই বৈদেশিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়, অর্থপ্রদানের মেয়াদ বাড়াতে হয় এবং বৈদেশিক ব্যাংগুলোর মাধ্যমে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) নিশ্চিত করতে হয়। সামনে এর সবই আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া, বাংলাদেশে ৬২টি ব্যাংক রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকগুলো ব্যাংকই উচ্চ নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল), প্রভিশন ঘাটতি এবং দুর্বল গভর্নেন্সসহ আরও কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

বাংলাদেশের সামাজিক ঝুঁকির অবস্থানও বেশ নেতিবাচক পর্যায়ে। উচ্চ ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের হার কমেছে। এতে মৌলিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষার সুযোগ ও ফলাফল, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং জনশক্তিকে অন্তর্ভুক্তিকরণের মতো বিষয়গুলো সামাজিক ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন পরিস্থিতি-এর রেটিংকে সীমাবদ্ধ করেছে এবং এতে গর্ভন্যান্স ইস্যুয়ার প্রোফাইল স্কোর ‘জি৪’ দাঁড়িয়েছে, যা উচ্চমাত্রায় নেতিবাচক। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করছে, যেখানে আইনি কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতাও সীমিত। এসব সুশাসন চ্যালেঞ্জের বিষয়টি ব্যাংক খাতের সম্পদের মানের ক্ষেত্রেও আংশিক অবদান রেখেছে। পাশাপাশি একটি অবনতিশীল মুদ্রানীতি কাঠামো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে অবমূল্যায়িত করেছে এবং আর্থিক বিচক্ষণতাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে বলে মনে করছে মুডি’স যার ফলে নীতিনির্ধারকদের আরও সতর্ক হতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত