ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাজেট পর্যালোচনা

বাজেট ঘাটতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব

মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলাম লেখক, [email protected]
বাজেট ঘাটতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব

২০২৩-২৪ নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে আয়ের প্রাক্কলন হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এতে সামগ্রিক ঘাটতি হবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা যা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ঘাটতির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের প্রত্যাশা করছেন এবং বাকি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারকে সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির মতো ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে বাকি ২৩ হাজার কোটি টাকা। সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে এই ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সরকারের বাজেট ঘাটতি পূরণকে অর্থনীতির ভাষায় ক্রাউডিং আউট প্রভাব বলা হয়। এটা এমন একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন বর্ধিত সুদের হার ব্যক্তিগত বিনিয়াগ ব্যয় হ্রাসের দিকে পরিচালিত করে যাতে এটি মোট বিনিয়াগ ব্যয়র প্রাথমিক বৃদ্ধিকে কমিয় দেয়। কখনও কখনও সরকার একটি সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতির অবস্থান গ্রহণ করে এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে অধিক চাঙ্গা করার জন্য তার ব্যয় বৃদ্ধি করে। এর ফলে সুদের হার বৃদ্ধি পায়। বর্ধিত সুদের হার ব্যক্তিগত বিনিয়াগের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। ক্রাউডিং আউট প্রভাবের একটি উচ্চ মাত্রা যা অর্থনীতিতে কম আয়ের দিকে নিয় যেতে পারে। উচ্চ সুদের হারের সঙ্গে বিনিয়োগের জন্য তহবিলের ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং ঋণ অর্থায়নের ব্যবস্থায় তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রভাবিত করে। এটি শেষ পর্যন্ত কম বিনিয়াগের দিকে নিয় যায় এবং মোট বিনিয়াগ ব্যয়র প্রাথমিক বৃদ্ধির প্রভাবকে প্রভাবিত করে। এটা সাধারণত সরকারি ব্যয়র প্রাথমিক বৃদ্ধি উচ্চতর কর ব্যবহার করে বা সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ নিয় অর্থায়ন করা হয়। য়ে

ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতির মুল কাণ্ডারি। দেশের মুদ্রা সঞ্চালনের ধারক ও বাহক। অর্থনীতি উন্নয়নের চালিকাশক্তি। অদৃশ্য এক শক্তি করোনাভাইরাসের দাপটে দুই তিন বছর টালমাটাল ছিল দেশের অর্থনৈতিক বাজার। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত বছর শুরু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয় এবং মানুষের জীবনযাত্রা নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক দেশই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে দেশের আমদানি রপ্তানি ও বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ। ব্যাংকগুলোও ভুগছে তারল্য সংকটে। অনেক ব্যাংক নতুন করে কোনো ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করতে পারছে না। বলতে গেলে প্রতিটি ব্যাংকের বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের কাজে মন্থরগতি। ব্যাংক খাতে এর নেতিবাচক সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে।

ব্যাংক একটি দেশের অর্থনৈতিক উপকরণগুলোকে সমন্বিত করে, আর্থিক সহায়তা দিয়ে, পরিচর্যা করে, উপদেশ দিয়ে, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে উদ্যোক্তার ভবিষ্যত স্বপ্নের কাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে। দেশের অর্থনীতির প্রসার ঘটিয়ে উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখে। আবার বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা কিংবা অভয় দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি দান করে। দেশের ব্যবসা খাতগুলোকে সমৃদ্ধ করে। বলা চলে, দেশের শিল্প ব্যবসায় খাত আর দেশের ব্যাংক খাত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে এদেশের ব্যাংক খাত বিভিন্ন সময়ে নানা ঘাত প্রতিঘাতে পর্যুদস্ত। ব্যাংকিং খাত করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল। নতুন করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। গত বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চাউর হয়েছিল যে, কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে গ্রাহকের কোটি টাকা আমানত থাকলেও মাত্র ১ লাখ টাকা পাবে গ্রাহক। এতে করে গ্রাহকদের মাঝে দেখা যায় চরম আতঙ্ক। উপায়ন্তর না দেখে অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যায় এবং সেই অর্থ এখন পুরোপুরি ব্যাংক ব্যবস্থায় ফিরে আসেনি। যা ব্যাংক ব্যবস্থার তারল্য সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করেছে।

এর পর এ আতঙ্ক শেষ না হতেই আবার এলো সরকারের ‘নয়ছয়’ বাস্তবায়নের গোলকধাঁধা সিদ্ধান্ত। বলা হচ্ছে ব্যাংক ৬ শতাংশ হারে গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করবে আর ৯ শতাংশ হারে বিনিয়োগ করবে। সরকার একদিকে বলছে মুক্তবাজার অর্থনীতি আবার ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নয়ছয় চাপিয়ে দেওয়া কিছুটা দ্বিমুখী নীতিও বটে! অর্থনীতিবিদরা শুরু থেকেই বাজার ব্যবস্থা উপেক্ষা করে নয়ছয় চাপিয়ে দেওয়ার সমালোচনা করছেন। যেখানে বেসরকারি ব্যাংক সাধারণ ঋণে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ হার পর্যন্ত বিনিয়োগ করত। সেখানে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে সকল ব্যাংককে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাধ্য করা হয়েছে, যা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অনেকে বলছেন মুষ্টিমেয় কিছু লোককে বাড়তি সুবিধা দিতেই সরকারের এই নয়ছয় ব্যবস্থা। তবে করোনা মহামারির সংকটে এটার বাস্তবায়ন স্থগিত করাই শ্রেয় ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে এর অবসান হবে এমনটাই অনেকে প্রত্যাশা করেছিল; কিন্তু সে আশায়ও গুড়েবালি! সরকার বলেছিল, এতে নিত্যপণের দাম কমবে, বিনিময়ে বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে থাকবে; কিন্তু বর্তমানে ৯ শতাংশের বেশি, ভোক্তারা দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত চাপে অতিষ্ঠ।

প্রকৃত অর্থে ব্যাংকিং খাত করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল। নতুন করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্যাংকিং ব্যবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। করোনার কারণে অনেক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বন্ধ হয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি জটিল হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। তাছাড়া করোনার কারণে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা যায়নি। ফলে কোনো ঋণ আশানুরূপ আদায় হয়নি। এ কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে পাহাড়সম খেলাপি ঋণ জমা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ বছরের মার্চের শেষে দেশে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা এবং এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা অর্থাৎ এখন ব্যাংক ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই খেলাপি। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের জন্য উদ্বেগজনক চিত্র। তাছাড়া, গণমাধ্যমে প্রকাশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং এ হার ৮.৮০ শতাংশ। শীর্ষে রয়েছে শ্রীলঙ্কা এবং এ হার দেশটির মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের দেশ নেপালে এবং এ হার ২ শতাংশের কম।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাত মারাত্মক তারল্য সংকটে আছে। ফলে ঋণের চাহিদা ও আমদানি ব্যয় মেটাতে অনেক ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ নিলে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ঋণ থেকে বঞ্চিত হবে বেসরকারি খাত। যার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যাংক ঋণের সুদ হারেও। বাজেটের সঙ্গে প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। ডলার সংকট, আমদানি হ্রাস, উৎপাদন কম ইত্যাদি কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ এমনিতেই বেশ কমে গেছে। তারপরও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, নতুন অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়ে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ হবে, এ এক অলীক স্বপ্ন এবং বাজেট বক্তৃতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ রকম অলীক প্রত্যাশা অবশ্য আরও আছে। যেমন মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা, যা এখন ৯ শতাংশের বেশি, অথচ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পরিকল্পনাই বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।

ব্যাংক ব্যবস্থা এমনিতেই নাজুক অবস্থায় আছে। করোনাকালীন সরকার ঘোষিত প্রণোদনা সহায়তা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্বও পড়েছিল ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর। এসব প্রণোদনার অনেক গ্রাহকের ঋণও খেলাপি হয়েছে। মোটকথা পাহাড়সম মন্দঋণ, একক সুদের হার বাস্তবায়নের ধাক্কা, কোভিড-১৯-এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। বাজেট ঘাটতির অর্থ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার গ্রহণ করলে বেসরকারি ঋণ প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে আমদানি, রপ্তানি, কর্মসংস্থান, সম্পূরক শুল্ক আদায়সহ নানা খাতে। কারণ সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত এবং একটির অবনতি হলে আরেকটি প্রভাবিত হয়। এর প্রভাবে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। শুধু রপ্তানির ওপর নির্ভর না করে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী যে শিল্পগুলো আছে, সেগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প হিসেবে পুঁজি বাজার থেকে স্বল্পমেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত