পানির জন্য হাহাকার!

মো. আতিকুর রহমান, কলামিস্ট ও সাবেক, জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে সুপেয় পানি প্রাপ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যে সারাদেশে পানির চরম হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। রাজধানীতে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদার কারণে এর আশপাশের এলাকাগুলোতে পানির এই সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করছে। বিশেষ করে নদীতে পানি না থাকা, অতিমাত্রা দূষণ ও খরা মৌসুমে পানির অভাবে কৃষি ও আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ে হটলাইনে কিংবা সশরীরে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না। আর ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, লোডশোডিংয়ের কারণেও কমেছে পানির উৎপাদন ও সরবরাহ।

বর্তমানে রাজধানীর বাসাবাড়িতে সারা দিনে এক থেকে দুইবারের বেশি পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সারাদিনে এসব এলাকায় যেটুকুই বা পানি সরবরাহ করা হয়, তাও আবার ব্যবহারের অনুপযোগী। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে চাহিদ অনুযায়ী পানি উত্তোলন ও সরবরাহ নিশ্চিত করাও সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে কম বৃষ্টিপাত, সেইসঙ্গে জনসংখ্যা ও চাহিদা বাড়ার কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামছে। এজন্য শতাধিক পাম্প বিকল হয়ে পড়েছে। লোডশোডিংয়ের কারণেও পানির উৎপাদন ও সরবরাহ কমছে। পাশাপাশি নতুন পাম্প বসানোরও জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রেশনিং করে পাম্প চালাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পানির স্থির স্তর ২৬০-২৮০ ফুট নেমেছে আর পানি উঠানো হচ্ছে ৯৫০-১০০০ ফুট নিচ থেকে। ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, তাদের দৈনিক পানির চাহিদা ২৬৫ কোটি লিটার। এর ৬৪ শতাংশ আসে ভূগর্ভের পানি থেকে। পানির স্তর বেশ নিচে চলে যাওয়ায় প্রায় এক হাজার ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। রূপগঞ্জের গন্ধবপুর পানি শোধনাগার চালু হলে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরতা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে আসবে বলে আশাবাদী তারা।

এদিকে, মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করতে ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল ওয়াসা। তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরও এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। এই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। শোধনাগার ও পানির লাইনের নির্মাণকাজ শেষে কবে নাগাদ মেঘনা নদীর পানি ঢাকাবাসী পাবে সেটি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

শুধু তাই নয়, পদ্মা নদীর পানি রাজধানীতে সরবরাহ করতে তিন হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শোধনাগার থেকে পানি রাজধানীতে নিতে সরবরাহ লাইনই স্থাপন করেনি ওয়াসা। এতে শোধনাগারের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশই অব্যবহৃত থাকছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে নির্ধারিত সময়ে ভূ-উপরিস্থ পানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না ওয়াসা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহরে চাহিদার ৮০ শতাংশ পানি ভূর্গভস্থ থেকে মেটায় ওয়াসা। এতে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে কমতে থাকলে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে ওয়াসাকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। পদ্মা নদী থেকে ঢাকায় পানি সাপ্লাই দেওয়ার যে প্রকল্পের কাজ চলছে, তা শেষ করতে হবে দ্রুত সময়ের মধ্যে, যা অধিক জরুরি বলে মনে করি।

অপরদিকে পানির চাহিদা পূরণে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি কিনতে চাইলেও সেখানে ঘটছে হাজারো বিড়ম্বনা। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি অধিক লক্ষণীয় উক্ত প্রতিষ্ঠানের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের অধিক অর্থ না দিলে সময় মতো পানি পাওয়া যায় না, যা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আবার রাজধানীর কোথাও কোথাও পানির যত্রতত্র ব্যবহারও পরিলক্ষিত হচ্ছে।

মূলত রাজনৈতিক প্রভাব, দলীয় বিবেচনা ও সুশাসনের অভাবে ওই খাতের উন্নয়ন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে, যা অধিক উদ্বেগের কারণ বলে মনে করি। তাই জাতীয় পানি নীতি ও জাতীয় পানি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে দেশ ও জনগণের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ওই খাতে বিরাজমান সংকট উত্তোরণে সব ধরনের প্রভাব দূর ও দুর্নীতি ভুলে দেশের মৃতপ্রায় ছোট-বড় নদ-নদী, পানির উৎস, জলাধার, খাল-বিলসহ সকল প্রকার জলাভূমির উন্নয়ন, দূষণরোধ, সংরক্ষণ, পানির সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দিকে অধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে।

এই কাজে সরকারের সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পানির পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা, পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে পানির হিস্যা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান এবং নদ-নদীসহ সব ধরনের জলাধারে পানি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা স্থির করতে হবে। সেইসঙ্গে পানিসম্পদ রক্ষায় এই খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা কাঠামো তৈরির দিকে সরকারকে আরো অধিক দৃষ্টি দিতে হবে। এই খাতে অধিক দক্ষ ও সৎ লোক নিয়োগ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যা ওই সংকট মোকাবিলায় দেশ ও জনগণের কল্যাণে অধিক জরুরি বলে মনে করি।

মূলত সরকারের সংশ্লিষ্টদের অধিক উদাসীনতা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে স্থায়ী বিরোধ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য ও ভূমি দস্যুদের অপতৎপরতা, দোষীদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনা ও তাদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া, আইনি দুর্বলতা, ঘুষবাণিজ্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অর্থলিপ্সা এবং অধিক নজরদারির অভাবে এদেশের এমন অনেক নদ-নদীকে অবলীলায় হত্যা করা হচ্ছে। মূলত এদেশের কিছু অর্থলোভী অসাধু ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থকে বলি দিচ্ছে।

বিভিন্ন সরকারের আমলে সংশ্লিষ্টদের সার্বিক সহযোগিতায় তারা অবাধে এই কাজগুলো চালিয়ে গেছে, যা দুঃখজনক। এমন এক অবস্থায় যদিও বর্তমান সরকার ধ্বংস বা মৃতপ্রায় নদ-নদীগুলোকে পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ স্বরূপ নদনদী খনন, নদী শাসন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, ভূমি দস্যুদের তৎপরতা রোধ, দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত, পরিবেশ রক্ষা আইনের দুর্বলতা দূরীকরণ, শিল্পকারখানার দূষিত বর্জ্য শোধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ পাশাপাশি অধিক জনসচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে, যা ইতিবাচক বলে মনে করি। এখন সরকারের পাশাপাশি পরিবেশবিদ, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন, বিত্তবান, শিক্ষিত যুব সমাজ এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোকে সেবার মনোভাব এবং দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই কাজে সরকারকে সকল প্রকার সহযোগিতা করতে হবে।

যদিও ইদানীং প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘনঘন বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোনের মতো ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদেরকে প্রায়ই গ্রাস করছে। এতে দেশ ও জাতি হচ্ছে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও কৃষি খাত হচ্ছে বিপর্যস্ত। অনুরূপভাবে ভূগর্ভস্থ পানি অধিক ব্যবহারের ফলেও পানির আর্সেনিক দূষণ জনগণের জীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

ভয়াবহ পানি দূষণের ফলে দেশে বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ পানির সংকটও দিনদিন তীব্র আকার ধারণ করছে। প্রতিবছর প্রয়োজনীয় নদী শাসন না হওয়ায় অধিক বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে সরকার যে পরিমাণ অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয় করছেন, সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে সরকার যদি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নদ-নদীগুলোকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ, নদী শাসন বিশেষ করে নদীর দূষণরোধ, নদী খননের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে নদী-নালাকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষায় উদ্যোগী হতো, তবে অধিক সুফল পাওয়া যেত। এতে সরকারের অর্থের সাশ্রয়ের পাশাপাশি অবাদি জমির ভাঙনরোধ, কৃষিতে প্রয়োজনীয় সেচ ঘাটতিপূরণ, আর্সেনিক দূষণরোধ, নদীপথে জীবিকা অর্জনকারীদের রক্ষাকরণ, স্বল্প ব্যয়ে নৌপথে পণ্য আনা-নেয়াকরণ, ভবিষ্যতে পানির সংকট মোকাবিলাসহ নদীপথে যোগাযোগ সুরক্ষা পেত। এই বিষয়গুলোর প্রতি সংশ্লিষ্টদের অধিক দৃষ্টি দিতে হবে।

যদিও ইদানীং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে অধিক তৎপরতা ও নদীর দূষণরোধে কিছু ঝটিকা ও উচ্ছেদ অভিযান পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা ইতিবাচক বলে মনে করি। সরকারের ওই কর্মপ্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক এমনটিই অধিক প্রত্যাশা করি। এর পরও যদি আমরা প্রকৃতির আশীর্বাদ স্বরূপ পাওয়া এইসব নদনদীকে রক্ষায় ব্যর্থ হই তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ এই নদীগুলোই একদিন আমাদের মাঝে বড় ধরনের অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে।

কেননা আমরা চাই না আমাদের সামান্য ভুল ও অবহেলায় প্রকৃতির আশীর্বাদস্বরূপ পাওয়া এইসব নদনদীগুলো অভিশাপ হয়ে আবার আমাদের মাঝে বিরাজ করুক। আমরা চাই না যে, নদনদীগুলো তার অপার মহিমা, সেবা ও বুক দিয়ে আমাদের এতদিন আগলে রেখেছে, তা সামান্য ভুলের কারণে করুণ মৃত হোক। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে মৃত নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে একটু দরদি ও সচেতন হই এবং নিজেদের ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করি। যার যতটুকু সাধ্য আছে তা দিয়েই মৃতপ্রায় নদীগুলোকে রক্ষায় আত্মনিয়োগ করি। শুধু আমাদের সবার অধিক সচেতনতা, সততা এবং সদিচ্ছাই পারে এদেশের মৃত ও দূষিত নদ-নদীকে রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে। প্রকৃতির এই ঋণ শোধে সবার ভেতরে সেই সদিচ্ছাটুকু জাগ্রত হবে- এমনটিই প্রত্যাশ।