ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আপনাদের ভাবনা

র‌্যাঙ্কিং ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নে পদক্ষেপ

মোস্তফা কামাল
র‌্যাঙ্কিং ও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নে পদক্ষেপ

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউ এস) বিশ্বের সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ১০ জুন কিউ এস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিংয়ে ২০২১ শীর্ষক এ তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। র‍্যাংকিংয়ে ঢাবি বুয়েটের অবস্থান ৮০০ থেকে ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেনি কিউ এস। এর আগের জরিপেও একই অবস্থান ছিল এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ নিয়ে টানা চতুর্থবার কিউ এস রেংকিয়ে ৮০০-১০০০তম অবস্থানে জায়গা পেল ঢাবি ও বুয়েট। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছিল। সে বছরের তালিকায় ঢাবির অবস্থান ছিল ৭০১-৭৫০তম।

খবরটি হতাশাজনক। উচ্চ শিক্ষা এখন আর ভৌগোলিক চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের মতে, উচ্চ শিক্ষারও ব্যাপকতার বিশ্বায়ন ঘটেছে। এ কারণে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে। এ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সম্মানের, সমৃদ্ধির নতুন জ্ঞান জগতে এগিয়ে চলার। সাংহাই টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইডিই) কিউ এস এর মতো সংস্থা র‍্যাংকিং উচ্চ শিক্ষার প্রতিযোগিতায় নতুন মাত্রা এনেছে। এর মধ্যে কিউ এসের প্রকাশিত সেবা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। র‍্যাংকিং বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক প্রবণতার উল্টোপথে অবস্থান করছে। ইউ এস এর প্রকাশিত এ তালিকায় প্রথম দশটিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যও সুইজারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালগুলোর অবস্থান রয়েছে। প্রথম ১০০টি-তে রয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান। ২০০টির মধ্যে রয়েছে ভারতের তিনটি এবং সৌদি আরবের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান।

৩০০ থেকে ৫০০ মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো সমপর্যায়ে দেশগুলো বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রথম ৫০০ অবস্থানের মধ্যে থাকলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়নি তাতে। তথ্য অনুযায়ী (কিউ এস) এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে ঢাবি ও বুয়েট। এ অবস্থান তেমন কৃতিত্বের পরিচয় নেই। বৈশ্বিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন হতাশাজনক অবস্থান মৌলিক গবেষণা উচ্চ শিক্ষার মানে ঘাটতির পরিচয় বহন করে। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী সময়কালে এটা আদৌ অভিপ্রেত নয়। যেকোনো দেশের শিক্ষা ও গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হলো সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পুরোনো জ্ঞানের সংরক্ষণ ও বিতরণ এবং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল কাজ।

কবিগুরু বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বিদ্যার দান নহে, বিদ্যা উপাদান, মৌলিক গবেষণায় আসলে নতুন জ্ঞান সৃজন, যা ছাড়া জ্ঞানের উন্মোচন হয়না। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে অবস্থানরত ম্যানোচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি মূলত একটি গবেষণানির্ভর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি প্রথম সারির দিকের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্যও গবেষণাকেন্দ্রিক। এর অর্থ যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে নতুন নতুন গবেষণা হয়, সেগুলোর মানও বিশ্বমানের এবং তারা গবেষণাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা বিপরীত। ইউজিসির এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না। গবেষণার পরিবর্তে চলে মুখস্থনির্ভর চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা। শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় চাকরির চিন্তা, ভবিষ্যতের চিন্তা। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় হলো দেশে মুক্ত জ্ঞান চর্চার স্থান। শিক্ষার্থী শিক্ষকরা গবেষণা করবেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন, জাতিকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরবে- বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে ঠিক বিপরীত। শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হচ্ছে কিছু পাঠ্যবই, লেকচারশিট, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা আর নামমাত্র রিসার্চ পেপার, যার যথার্থতা শিক্ষকরা বিচার করে দেখেন না। ছাত্রদের মুক্ত জ্ঞান চর্চার সুযোগ না দিয়ে ক্লাসে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা হয়। বৈশ্বিক মানে এগিয়ে যেতে হলে পাঠদানের গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে গবেষণাকেন্দ্রিক পাঠদানে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। এটা ঠিক যে, গবেষণায় জনবাস্তিক কিছু সমস্যাও রয়েছে, গবেষণায় বরাদ্দ কম। আগ্রহী শিক্ষকদের তেমন কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয় না। বেসরকারি পর্যায়ে থেকেও গবেষণা অনুদান দেওয়ার প্রথা নেই বললেই চলে। তাই অনেকের ইচ্ছা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত গবেষণা করতে পারে না। আবার অন্যদিকে গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যা বরাদ্দ দেয়া হয় তা অনেক সময় ঠিকমতো ব্যয় হয় না। আনুগত্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক দলীয় রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কারণে যথার্থ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণা সংক্রান্ত তথ্য পান না। এতে গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে। তাই গবেষণার মান-পরিমাণ বাড়াতে হলে এসব বিষয়ের সুষ্ঠু সুরাহা অপরিহার্য।

জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিই এ যুগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের সাদামাটা পাঠদান ও সনদ বিতরণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। ঐতিহ্য নিয়ে বড়াই করাটাই এখন বোকামি হিসেবে গণ্য করার দিন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের নব নব তত্ত্ব ও তথ্যের উদ্বোধক সৃষ্টির কেন্দ্র। তাই আমাদের প্রত্যাশার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কর্তৃপক্ষগুলো নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-সুনাম বাড়াতে উদ্যোগী হবে।

শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত