বিশ্বের কথিত প্রবল ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৪ মে ২০২৩ নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। যে কোনো দেশই নিজস্ব ভিসানীতি থাকে। এই ভিসানীতি সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তনও অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসানীতি প্রণীত হলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এ ভিসানীতি ঘোষিত হয়েছে বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ইস্যু করে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সেসঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বাধা প্রদানকারী এবং বিঘ্ন সৃষ্টিকারিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া হবে না। অর্থাৎ চিহ্নিত বাধা প্রদানকারী ও বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ভিসাপ্রাপ্তির যোগ্য হবেন না। ভিসানীতিতে এও বলা হয়েছে যে, ভিন্নমতাবলম্বী বা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদানকারিরাও ভিসা পাবেন না। ভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে- এই প্রতিফলনেই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থেই ভিসানীতি ঘোষণা করেছে বলে আমেরিকান পররাষ্ট্র দপ্তর ব্যাখ্যা দিয়েছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভিসানীতি নানাভাবে বিশ্লেষণ করছে বিভিন্ন মহল। এ নিয়ে বেশ কিছু লেখাও ছাপা হয়েছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। টেলিভিশনের টকশোগুলোতেও এটাকে বিষয় করে আলোচনা হয়েছে বেশ, এখনও হচ্ছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারাও বিষয়টি নিয়ে এতটাই গলদঘর্ম, একেবারে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা। প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের ছক্কামারার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। বিএনপি বলছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে সরকার ঘাবড়ে গেছে বা ভয় পেয়ে গেছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘আমেরিকার ভিসানীতি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সহায়ক হবে।’ সরকারি দল আওয়ামী লীগের একেক নেতা একেকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির অপরাজনীতিকে দায়ী করেছেন। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতি, নির্বাচন প্রতিহত করার রাজনীতির কারণেই মার্কিন ভিসানীতি অবস্থান ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, ভিসানীতির কারণে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সুযোগ নেই।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতু মন্ত্রী বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে বিএনপি বেকায়দায় রয়েছে, এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহাবুব চৌধুরী বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক হবে। বিএনপি এই নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষও মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ইতিবাচক-নেতিবাচক ও রসবাচক মন্তব্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এক কথায় ভিসানীতিতে সব মহলই কমবেশি শঙ্কিত। কেননা, এই দেশটির প্রতি আগ্রহ অনেকটা বেশি। এর কারণও রয়েছে যথেষ্ট- আমি সে কারণ ব্যাখ্যা করতে চাই না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে এত উৎসাহি হয়ে উঠল কেন? এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধাবাদী আচরণই হচ্ছে তাদের গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়। জর্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ক্যাটাগরিক্যাল ইম্পারেটিভস প্রথম নীতিটি হচ্ছে- সার্বজনীনতার নীতি। এ নীতি একটি সূত্রকে অনুসরণ করে প্রণীত হয়েছে, সূত্রটি হচ্ছে- ‘আপনি সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী এমনভাবে কাজ করুন যেন আপনার মনে হয় যে, সার্বজনীনভাবে কাজটি তেমনভাবেই করা উচিত।’ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সার্বজনীনতার জন্য কান্টের দর্শন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি তা ক্ষেত্র বিশেষ অনুপস্থিত। আধিপত্য বিস্তার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ। যেসব ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্লোগান যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে সুবিধা নিয়ে আসতে সক্ষম, সেসব ক্ষেত্রে দেশটি নিজ স্বার্থে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকে। আর যেখানে মানবাধিকারের বুলি তাদের কোনো স্বার্থ উদ্ধারে সক্ষম নয়, বরং সমস্যায় ফেলতে পারে সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের সার্বজনীনতাকে নিমিষেই প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতির যে পরিবর্তনই আনুক না কেন- দিন শেষে সন্ত্রাস, জঙ্গি ও গণতন্ত্র ধ্বংসকারী ও মানবাধিকার লংঘনকারীরা সবার আগে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেয়ে যাবে, অতীতে আমরা সেটা দেখেছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনিদের বেশিরভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। যারা লুটেরা দুর্নীতিবাজ তারা কী গণতন্ত্রের বাহক? অথচ এ লুটেরা শ্রেণি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেয়ে যায় সহজে। উল্লেখ্য, বিশ্বের প্রায় ৮০টির মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, তাদের ঘাঁটিকৃত অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্র নেই। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমাহীনভাবে হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরিতে নানা ফন্দি আটছে যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের রাজনীতিকদের যদি বোধোদয় না হয়, তবে পস্তাতে হবে একদিন। এদিকে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক দল ও সরকারি আমলাদের সঙ্গেও বৈঠক করছেন ধারাবাহিকভাবে। তবে বৈঠক ভিসানীতির ঘোষণার আগ থেকেই শুরু হয়েছে। কূটনৈতিক কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রদূতরা বৈঠক করতেই পারেন। সরকারি আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন এটাতো স্বাভাবিক, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কৌশলগত সুবিধার কথা মাথায় রেখেই রাষ্ট্রদূতরা বৈঠক করে থাকেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পিটার হাসের বৈঠকের অন্যরকম তাৎপর্য বহন করে। কেননা, আর মাত্র কয়েক মাস পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠ অনেকটাই উত্তপ্ত প্রায়। সরকারি দল বিরোধীদল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও জোট মাঠ গরম করছে। বৈঠকে পিটার হাসের কাছে কেউ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে বিচারও দাবি করছে। রাজপথে জনগণকে সঙ্গে না পেয়ে চোরাবালির পথ বেছে নিয়েছে অনেকে। এ গলিপথের সন্ধান পেতে হলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দূতদের সহযোগিতা অপরিহার্য। অতীত ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দিয়ে আসছে।
তাই পিটার হাসের সঙ্গে ফিরিস্তি বৈঠকে কোনো কোনো দল আনন্দে গদ গদ করছে। বিএনপি তো ধরেই নিয়েছে ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেন-দরবার করা। জনগণের প্রতি তদের কোনো আস্থা ও বিশ্বাস নেই। যদি থাকত, তবে জনগণ বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসত। অথচ কী আশ্চর্য। জনগণ তাদের ডাকে ১৪ বছরেও সাড়া দেয়নি। সে জন্যই তারা কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন দূতাবাসে। জনগণই যে ক্ষমতার উৎস সেটি ভুলে গেছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও বৈঠক করছে বটে; কিন্তু শেখ হাসিনা কাউকে পরোয়া করছে না। আমেরিকার মতো প্রভাবশালী দেশকেও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। শেখ হাসিনা জানেন, দেশকে সাবলম্বী করতে হয় কীভাবে। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের বিস্তর ফারাক রয়েছে। দেশ আজ শক্তভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষি অর্থনীতি অনেক শক্তি অর্জন করেছে। পোশাক খাতে যে রেমিট্যান্স আসে তার ২৫ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র যদি আগ্রাসী নীতির পরিবর্তন না করে, তবে ২৫ শতাংশ রেমিট্যান্স অন্য কোনো দেশ থেকে পুষিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর কোনো দেশকে আর তেলিয়ে চলতে হবে না আমাদের। সবার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিশ্বাসী বাংলাদেশ। আজকের যুগে কোনো দেশই একা চলতে পারে না। পরস্পর পরস্পরে নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র যত শক্তিশালীই হোক ভূরাজনীতির স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতেই হবে। শেখ হাসিনা আমেরিকাকে যে ছবক দিয়েছে, তাতে বুঝতে হবে এটা শুধু আমেরিকা নয়, আমাদের ওপর আধিপত্যবাদ বিস্তারে যারাই তৎপর থাকবে, তাদেরও এই ছবক খেতে হবে। শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ সব সূচকেই অনেক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। তবে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। চোখ কান খোলা রাখতে হবে। এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতি কতটা বদলে যায় বা কীভাবে ভূরাজনীতি সাজানো হয়।
পরিশেষে বলতে চাই, মার্কিন ভিসানীতিকেন্দ্রিক আলোচনায় রাজনীতির নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সব দলই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে যে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। পুরোপুরি বিতর্কহীন নির্বাচন না হলেও সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মানসকন্যা গণতন্ত্রের লড়াইয়ে তিনিই প্রথম কাতারের সৈনিক। দেশকে ভালোবাসেন বলেই কোনো হুমকির কাছে মাথানত করতে হয় না তাকে। অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কেউ আমাদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে, তা কোনো দিন হবে না, অন্তত শেখ হাসিনা সে সুযোগ কখনও দেবেন না। শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছেন জনগণ তার সঙ্গেই আছে। কেননা, তিনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন। ভিসানীতি তার কাছে কোনো বিষয় নয়। তাইতো সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন ‘আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকা না গেলে কিছু যায় আসে না। দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রামনষা নেতাদের পৃথিবীর কোনো দেশই ভিসা না দিয়ে পারে না। বরঞ্চ আদর আপ্যায়ন করেই ভিসা দিয়ে থাকে। শেখ হাসিনার সাহসী উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষকেও নির্ভীক করে তুলেছে। ভয়হীন ও হৃদয়বেত্তার সমন্বয় ঘটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান রয়েছে শেখ হাসিনার সাহসী উচ্চারণে।