ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মতামত

ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ ফেল : দায় কার?

মিকাইল হোসেন, ভাইস প্রিন্সিপাল (অ্যাডুকেশন), এটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাব্লিসমেন্ট কলেজ, সাভার, ঢাকা। [email protected]
ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ ফেল : দায় কার?

২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিজ্ঞান ইউনিটে’র ভর্তি পরীক্ষায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর পায় ১১ হাজার ১০৯ জন। পাসের হার ৯.৪৩ শতাংশ মোট আসন সংখ্যা ১৮৫১টি। ‘চারুকলা ইউনিটে’ ভর্তি পরীক্ষায় ৪ হাজার ৭২৬ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে পাস নম্বর পায় ২১২ জন। পাসের হার ৪.৪৯ শতাংশ। ‘কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে’ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ লাখ ১৫ হাজার ২২৩ জন শিক্ষার্থী। পাস নম্বর পায় ১১ হাজার ১৬৯ জন। পাশের হার ৯.৬৯ শতাংশ। মোট আসন ২ হাজার ৯৩৪টি। ‘ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে’ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় ৩৮ হাজার ২২৫ জন শিক্ষার্থী। পাস নম্বর পেয়েছেন মাত্র ৪ হাজার ৫২৬ জন শিক্ষার্থী। পাশের হার ১১.৮৪ শতাংশ। এসব শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাস মার্ক ৪০ নম্বরও পাননি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর অনেক দেশ অনেক বড় বড় খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যে একটি দেশের ভাষা রক্ষায় এবং স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সব পর্যায় অবদান রেখে জাতিকে কৃতজ্ঞতা বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জাতিগতভাবে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ এ বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়ে ইতিহাসের অংশ থেকে প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় লাখ লাখ শিক্ষার্থী। ঢাকা শহরের নামকরা কলেজ থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজের শিক্ষার্থীরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করে দেশ সেরা মেধাবীদের তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য। বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেরা শিক্ষার্থী বাছাই করে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে। বর্তমানে বহুনির্বাচনি ও লিখিত প্রশ্নের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেন। সমস্যা হচ্ছে- এ ভর্তি পরীক্ষার মানসম্মত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের গলদঘর্ম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো মানসম্মত প্রশ্ন করবে। তারা চেষ্টা করবে সেরা মেধাবীদের ভর্তি করার জন্য। ছাত্রছাত্রীরা চান্স না পাক পাস নম্বর তো পাবে। অনেকের মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, সেটি হচ্ছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন করে কি-না? হ্যাঁ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন একটু কঠিন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? তাই বলে ছাত্রছাত্রীরা পাস নম্বর পাবে না তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে ধরনের পড়াশোনা তারা করছে তা ভর্তি পরীক্ষার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে পারছে না যা সত্যিকার অর্থে শিক্ষার মান নিয়ে ভাবনার বিষয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অবস্থা তা নয়, দেশের অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের চিত্র এমনই। ফলাফল হচ্ছে- মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ভালো ফলাফল নিয়ে ও তারা ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারছে না। যা আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। লাখ লাখ এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযোগী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। যদিও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস থেকেই করা হয়। পরীক্ষার বিস্তারিত সিলেবাস প্রসপেক্টাসে আগেই উল্লেখ করা হয়। ছাত্রছাত্রীরা প্রস্তুতি নিয়েই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করে। অসংখ্য ছেলেমেয়েরা মফস্বল থেকে আসে, তাদের হয়তো কোচিং করার সবার সামর্থ্য থাকে না। ৯০ শথাংশ শিক্ষার্থীর ফেল করার অন্যতম কারণ হচ্ছে তারা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে, সেখানে তাদের শুধু জিপিএ প্রাপ্তির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা দেয়া হয় না। অধিকাংশ কলেজে ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত কলেজে যায় না। ফলে তাদের সিলেবাস সম্পর্কে ধারণাই থাকে না। এছাড়া যোগ্য শিক্ষক না থাকা অন্যতম একটি সমস্যা। ছাত্রছাত্রীদের এসব অযোগ্য শিক্ষরা প্রাইভেট পড়ানোর জন্য শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান করেন না। বিজ্ঞানের শিক্ষকবৃন্দ ব্যবহারিক নম্বরের কথা বলে ছাত্রছাত্রীদের জিম্মি করে প্রাইভেট পড়ান। টাকার বিনিময়ে পূর্ণ নম্বর পান। ফলে তারা শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া অধিকাংশ অভিভাবকবৃন্দ অসচেতন হওয়ায় তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চিন্তা করতে পারেন না। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সহজে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি জিপিএ পেয়ে তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়াশোনা কম করে। আর লাখ লাখ এ প্লাস প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর না পায়, তাহলে সেটা অশনিসংকেত ছাড়া আর কিছু না। ছাত্র, শিক্ষক আর অভিভাকদের সচেতন হতেই হবে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত কলেজে আসতেই হবে। একজন ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সে চিরকূটে উল্লেখ করেছে। সে কথা। তাই অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীর সামর্থ্যরে বাইরে তাকে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলেও জীবন থেমে থাকবে না। আর এই মানহীন এ প্লাস প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীরা যখন কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, তখন তারা গবেষক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না। তারা সার্টিফিকেট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকছে। জাতিকে তারা তেমন কিছু দিতে পারছে না। তাই সময় থাকতে আমাদের এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভাবতে হবে। অন্যথায় জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত