কোনো একটি বিলবোর্ড বা পোস্টারে একবার লেখা দেখেছিলাম : ‘একটু বেশি পিওর’। একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন হিসেবে উক্তিটি লেখা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টির মধ্যে হয় কোনো রসিকতা, না হয় অজ্ঞতা রয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। অতি বিশেষণ অনেকক্ষেত্রে মূল গুণকে সীমিত করে। অর্থাৎ এখানে কেউ যদি কোনো পণ্যের মান পিওর বা খাঁটি বলে প্রচার করতে চান, তাহলে এটুকু বললেই হয়, পণ্যটি খাঁটি বা পিওর। একথার মাধ্যমে জোড়ালোভাবে বা সুস্পষ্টভাবে দাবি করা হয়, ওই পণ্যটির গুণগত মান ভালো, এতে কোনো ভেজাল মিশানো হয়নি। কিন্তু বাড়তি বিশেষণ হিসেবে যখন পিওরের আগে ‘বেশি’ শব্দটি বসানো হয়, এতে করে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয় যে, পণ্যটি পুরোপুরি খাঁটি নয়। খাঁটির মাত্রায় এটি বেশ অগ্রসর। ভেজালের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। আমার ধারণা ওই পণ্যের বিজ্ঞাপনদাতারা এই সত্যকেই শৈল্পিকভাবে সবার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। তবে তারা যদি এমন কিছু বোঝাতে চান যে, পণ্যটি একেবারেই খাঁটি, কোনো ভেজাল নেই, তাহলে কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাদের পুনঃবিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকে আমরা এখন একটু আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে ব্যবহৃত কিছু বক্তব্য বা উক্তির দিকে নজর দেই। আমরা অনেক সময় বলতে শুনি ‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ এই কথা বলে কোনো প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রেমের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে চান। কিন্তু তাদের এই ‘অনেক’ নামক পরিমাণসূচক শব্দ দিয়ে ভালোবাসাকে তারা আরও বেশি গুণান্বিত করতে চাচ্ছেন, তা কিন্তু হচ্ছে না, বরং এর মাধ্যমে ভালোবাসাকে পরিমাণের মাত্রার মধ্যে আবদ্ধ করে সীমাবদ্ধ বা ছোট করে ফেলা হয়েছে। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’- এই উক্তিটি ‘অনেক’ যুক্ত উক্তিটির চেয়ে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী। কেননা, এখানে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ হওয়ার সুযোগ আছে, আমার সবটুকু ভালোবাসা শুধু তোমার জন্য। অথচ ‘অনেক ভালোবাসি’ বললে এমন বোঝাতে পারে, অনেককে আমি ভালোবাসি; কিন্তু পরিমাণের দিক দিয়ে তোমার প্রতি ভালোবাসা একটু বেশি আর কি! ‘সে আমার ভালো বন্ধু’- এধরনের উক্তি আমরা ব্যবহার করে থাকি। এতেও কিন্তু একটু নেতিবাচক (nagative) ভাব প্রকাশ পায়। ‘ভালো’ শব্দটি এখানে বন্ধুত্বকে উচ্চতর বা গভীরতরভাবে গুণান্বিত করে না। বরং এটা দ্বারা বন্ধুত্বকে শ্রেণি বিভাগ করা হয়। অর্থাৎ বন্ধুত্ব মন্দও হতে পারে, খারাপ বন্ধুও থাকতে পারে, অথবা যাকে ভালো বন্ধু বলা হচ্ছে, মাত্রার দিক থেকে সে একটু এগিয়ে। কিন্তু ‘ভালো’ বিশেষণটি বাদ দিয়ে যদি বলা হতো ‘সে আমার বন্ধু’- এই বাক্যটি ইতিবাচক ও শক্তিশালী। দৈনন্দিন জীবনের এমন অনেক আলাপী উক্তি আছে, যার মধ্যে বিশেষণ বা বলবর্ধক শব্দ ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা বরং ওই উক্তিতে নেতিবাচক বিষয়যুক্ত করে বসি বা নিজের বক্তব্যের মূল বিষয়কেই দুর্বল করে ফেলি।
প্রাত্যহিক জীবনের অবলীলায় ব্যবহৃত এসব বক্তব্য নিয়ে দর্শনে ব্যাপক আলোচনা লক্ষ্য করা যায়। অনেক দার্শনিকই এ অতিরিক্ত গুণারোপটিকে নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আধুনিক যুগ বা সপ্তদশ শতাব্দির আলোকময়তার যুগের একজন উল্লেখযোগ্য ডাচ দার্শনিক স্পিনোজা (Spinoza, 1632-1677) বলেছিলেন : ‘নির্ধারক মাত্রই নঞর্থক’ (All determination is negation)। অর্থাৎ কোনো কিছুকে যদি আমরা কোনো গুণ দিয়ে নির্দিষ্ট করতে চাই, তার গুণের নির্ধারক হিসেবে কোনো গুণবাচক শব্দ বা পদ ব্যবহার করি, তাহলে ওই বিষয়টিতে নেতিবাচক কালিমা লেপন করা হবে। যে বিষয়টিকে আমরা মহিমান্বিত করতে চাচ্ছি, তাকেই ছোট করা হবে। গুণের কম-বেশি বলা তো দূরের কথা, কোনো নির্দিষ্ট গুণকে নির্ধারণ করলেই এ ধরনের নঞর্থকতা বা সীমাবদ্ধতা এসে যাবে। তিনি তার ঈশ্বর সংক্রান্ত আলোচনায় এই সূত্রটি ব্যবহার করে দেখান যে, ঈশ্বর যদি স্বীকার করতে হয়, তাহলে তার ওপর অযাচিতভাবে কোনো গুণারোপ করা উচিত নয়, যৌক্তিকও নয়। কেননা, গুণারোপ করতে গেলে ঈশ্বরের অবস্থাকে ছোট করে দেখা হয়। এখন কথা হচ্ছে, কীভাবে? এটা দেখানোর আগে অন্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা যদি বলি ‘আকাশ হয় নীল’, তখন এর দ্বারা আকাশের ওপর নীল রংকে নির্ধারিত করে দেই। এই উক্তিটি একটি ইতিবাচক বাক্য। তবে নীল রং নামক গুণটিকে আকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা কিন্তু আকাশের অসংখ্য গুণকে অস্বীকার করছি, বা নেতিবাচক বলে স্বীকার করে নিচ্ছি। স্পিনোজার অভিমতটিও এমন ছিল। তিনি ঈশ্বরের ওপর কোনো গুণ আরোপ করতে অস্বীকৃতি জানান। তার মতে, ঈশ্বরের ওপর যদি কোনো বিশেষ গুণ আরোপ করা হয়, তাহলে তাকে সীমিত করা হয়। তার ওপর একটি বিশেষণ ব্যবহার করলে অন্য বিশেষণগুলো তার ওপর নেতিবাচক বা অস্বীকৃতিমূলক হয়ে যায়। যেমন আমরা যদি বলি ঈশ্বর হলেন আধ্যাত্মিক বা অজড় সত্তা (আকারহীন), স্পিনোজা বলবেন, তাহলে বস্তুজগতকে তার মধ্যে ধারণ করা বা বস্তুসত্তাকে তার ভেতরে নিয়ে আসার গুণ এই ঈশ্বরের নেই। বলা প্রয়োজন যে, স্পিনোজা মনে করতেন যে, ঈশ্বর ছাড়া কোনো সত্তা বা Substance নেই। দৃশ্য-অদৃশ্য, দৈহিক-মানসিক যে রকম জগত বা জাগতিক বিষয়ের কথাই আমরা ভাবি না কেন, সবই ঈশ্বরের মধ্যে অবস্থান করছে। আবার ঈশ্বর থেকেই সব বিশেষ বস্তু বা বিষয় অনুমিত বা সৃজিত হচ্ছে। ঈশ্বর এই সৃষ্ট বাস্তবতা এবং সৃজনশীল বাস্তবতা সবকিছুরই নিয়ামক। তাই জাগতিত বস্তু বা বিশেষ কোনো বিষয়ের ওপর আমরা যেমন নানা রকম গুণ আরোপ করি, এদের চিহ্নিত করি, আলাদা করি ঈশ্বরকে, তেমনভাবে কোনো বিশেষ গুণে বা মাত্রা দিয়ে নির্দিষ্ট করা সংগত নয়। কেননা, এতে করে তাকে ছোট করা হবে, সীমিত করা হবে, তার অভাবগ্রস্ততাকে উন্মুক্ত করা হবে। কিন্তু ঈশ্বর হতে হলে তাকে অবশ্যই অভাবহীন হতে হবে। কিন্তু গুণারোপ করলে অন্য অনেক গুণের অস্বীকৃতি জানানো হয়ে যায়। তাই স্পিনোজার মতে, ঈশ্বরকে কোনো গুণ দ্বারা বিশেষায়ণ করা বা নির্দিষ্টায়ন করার দরকার নেই, ঈশ্বরত্বই তার স্বরূপ- যেখানে কোনো কিছুর অভাব নেই।
স্পিনোজার ঈশ্বরকে ধর্মীয় ঈশ্বর ভাবার কোনো আবশ্যিকতা নেই, তিনি নিজে ধর্মের আদলে এ ঈশ্বরের ধারণা ব্যাখ্যা করেননি। তার প্রসঙ্গ ছিল জগতের মূল সত্তা, তার ভাষায়- Substance খুঁজে বের করা। যা হোক, যারা ধর্মীয় আদলে দর্শনচর্চা করেছেন, এবং জগতের স্রষ্টা, পরমসত্তা বা পরম প্রভুর প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন এমন চিন্তাবিদের কেউ কেউ কিন্তু এই মহাপ্রভুকে কোনো বিশেষ বিশেষ গুণ দ্বারা নির্ধারণ বা নির্দিষ্টায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সেমেটিক ধর্ম শ্রেণির চূড়ান্ত শাখা ইসলাম ধর্মভিত্তিক একদল ধর্মতাত্ত্বিক তথা ইসলামি দার্শনিক যারা মুতাযিলা বলে পরিচিত তারাও এমন কথা বলেছেন। তাদের মতে, আল্লাহতায়ালা একক অনাদি সত্তা, তার কোনো কিছুর অভাব নেই। তিনি কোনো কিছু দ্বারা সীমিত হতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহতায়ালার কোনো গুণ বা কতিপয় গুণ স্বীকার করলে এটা মনে হতে পারে যে, ওই গুণগুলোর বাইরে অন্য অনেক গুণই আল্লাহতায়ালার নেই। এতে চূড়ান্ত একক এবং অভাবহীন সত্তার ধারণায় বিচ্যুতি আসে। তাই কোনো নির্ধারক গুণ দ্বারা আল্লাহতায়ালাকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করা সংগত নয়। মুতাযিলা সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ওয়াসিল বিন আতা বলেন, আল্লাহতায়ালা এক পরম ঐক্য, যার মধ্যে সব গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে। তিনি একে বিভিন্ন গুণাবলীর এক অস্পষ্ট ঐক্য (a vague unity of different attribute) বলেও অভিহিত করেছেন।
মুতাযিলা চিন্তাবিদের অনেক দিকের সঙ্গে দ্বিমতকারী তৎকালীন একটি বিখ্যাত ইসলামি চিন্তাগোষ্ঠীর নাম আশারিয়া। তারাও আল্লাহতায়ালার একত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। তবে আল্লাহতায়ালার একত্ব প্রমাণ করতে হলে তার গুণগুলোকে অস্বীকার করতে হবে, এমনটি তারা মনে করেন না। তবে মানুষের গুণাবলী বা কোনো জাগতিক গুণাবলীর সঙ্গে এসব গুণকে এক করে দেখলে চলবে না। আল্লাহতায়ালার গুণাবলীকে তারা তার সত্তার মধ্যে এক জটিল সমন্বয়ের মাধ্যমে সন্নিবেশ করতে চান। তাদের এই ব্যাখ্যা এবং মুতাযিলাদের সঙ্গে তাদের মৌলিক বিরোধিতার বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, তারা উভয় সম্প্রদায়ই আল্লাহতায়ালার অসীম সত্তাকে, পরম একত্বকে খর্ব করে এমন কোনো গুণ আল্লাহতায়ালার ওপর আরোপ করতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে আল্লাহতায়ালার গুণকে তাঁর সত্তার মতোই মানবীয় বা জাগতিক সত্তা ও তাঁর গুণাবলী থেকে পৃথক করে দেখেন।
আমরা আবার আমাদের সহজ বুদ্ধির দর্শনে ফিরে আসি। একথা আমাদের স্বীকার করতেই হয়, জাগতিক কোনো ব্যক্তি বস্তু বিষয় বা ঘটনা- অসীম অনন্ত বা চিরন্তন নয়। সব কিছুতেই সার্বিক বিচারে রয়েছে সীমাবদ্ধতা। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ওই সীমিত গুণাবলীকেই আমরা যদি পু্েরাপুরি তুলে ধরতে পারি, তাহলে কিন্তু আমরা জাগতিক ওই বস্তু, বিষয় বা ব্যক্তির ক্ষেত্রে এক ধরনের ইতিবাচক বা পার্থিব অর্থে পূর্ণতার ধারণা পেতে পারি। কিন্তু তার ওপর আরও গুণ আরোপ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বস্তু বা বিষয়কে আমরা অনেক ক্ষেত্রে আরও বেশি সীমিত বা খাঁটো করে বসি। বিষয়টি ভাষা ব্যবহারের অসতর্কতার জন্যও হতে পারে। ভাষাদর্শনের বিশেষ পাঠ এ ক্ষেত্রে জরুরি বলে মনে করি। ভাষার গুণবাচক অলঙ্কার অনেক সময় তার ধারকের সামগ্রিক গুণকে যে সংকুচিত করে বসে সেদিকে আমাদের নজর দেয়া উচিত। আমাদের ভেবে দেখা দরকার বেশ সাধু মানে পুরোপুরি সাধু নয়, অনেক ভালো মানে সম্পূর্ণ ভালো নয়, অধিক বা অতিবাস্তব মানে বাস্তবই নয় এবং বেশি খাঁটি পদটিও প্রমাণ করে সংশ্লিষ্ট বস্তু বা বিষয়টি পুরোমাত্রায় খাঁটি নয়। শুধু পণ্যদ্রব্য বস্তু বা ঘটনাই নয়, সমাজ জীবনে কোনো কোনো মানুষকে মহান বলে, শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করার জন্য কোনো ব্যক্তি বা মহলকে মাঝে মধ্যে এমনভাবে গুণারোপ করতে দেখি, যাতে করে কার্যত ওই ব্যক্তিকেই তারা সংকীর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেন। আসলে যা ভালো বা খাঁটি তা পরিমাপ করা সব সময় শোভনীয় নয়।