ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছয় ইঞ্চির স্ক্রিনের হাতকড়ায় গোটা সমাজ

ইসরাত জাহান, শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
ছয় ইঞ্চির স্ক্রিনের হাতকড়ায় গোটা সমাজ

প্রাত্যহিক জীবনে নানান কাজের ভিড়ে যখন একটু অবসরতা মিলে, তখনই আমরা চোখ বুলাতে থাকি স্মার্টফোনের স্ক্রিনে, স্ক্রোল করতে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় সব তথ্যই মস্তিষ্কে ধারণ করছি। এ ইন্টারনেট দুনিয়ায় একবার প্রবেশ করলে এর থেকে বের হওয়া কঠিন ব্যাপার। এখন কয়েক মিনিটের জায়গায় কয়েক ঘণ্টাও চলে যায় হরহামেশাই; কিন্তু তা আমরা টেরই পাই না। অবসর সময় কাটানোর জন্য ধীরে ধীরে এ অভ্যেস আমাদের আসক্তিতে পরিণত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখেও মাঝেমধ্যে এ স্মার্টফোনে মজে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের মাঝে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠছে, যা মানুষকে গড়ে তুলছে অলস করে এবং কর্মবিমুখ করে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং সভ্যতার অগ্রযাত্রায় মোবাইল ফোন যেমন পৃথিবীকে নিয়ে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়, তেমনি এর অপব্যবহার মানুষকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। একটা ছোট্ট শিশু যখন খাবার খাওয়ায় অনিহা প্রকাশ করে, তখন অভিভাবক মোবাইলের লালসা দেখিয়ে খাবারে মন বসায় শিশুর। যা শিশুকে ধীরে ধীরে মোবাইলের প্রতি আসক্ত তুলে। শিশু যখন কান্না করে মাকে বিরক্ত করছে, মা তখন কান্না বন্ধ করার জন্য শিশুকে স্মার্টফোনের দিকে মনোযোগ আবদ্ধ করার চেষ্টা করে। এভাবে অজান্তেই আজকাল অভিভাবকরা বাচ্চাদের স্মার্টফোনের প্রতি আসক্ত গড়ে তুলে। স্মার্টফোনের কারণে খুব কম বয়সেই শিশু-কিশোররা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ‘মানুষের জন্য’ ফাউন্ডেশন এক গবেষণায় বলেছেন, রাজধানীর ৭৭ শতাংশ স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি-আসক্তি তৈরি হয়েছে। যার ফলে তাদের মধ্যে বিকৃত যৌনাচারের প্রবণতা তৈরি হয়েছে আশঙ্কাজনক হারে। এতে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এক সময় তৈরি হচ্ছে হতাশা। জড়িয়ে পড়ছে মাদকাসক্তির সঙ্গে। আত্মহননের ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

আমরা সচরাচর শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে স্ক্রিনবন্দি জীবনে আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি, তারা কি সত্যিকার অর্থে এই আসক্তি থেকে দূরে আছি? শৈশব, কৈশোর কিংবা যৌবনের পরিক্রমায় আমরা যে ভালো অভ্যাসগুলো অর্জন করেছিলাম, সেই অভ্যাসগুলো আমরা কি ধরে রাখতে পেরেছি? আমরা নিজেরা কি হারাতে বসিনি সামাজিকতা, মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা? সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই খবর কি আমরা রাখি? লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া, নিয়ম করে বিটিভির অনুষ্ঠান দেখা, গলা ছেড়ে কোরাস গান করা কিংবা স্কুল-কলেজের খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে আমরা কি নির্দয়ভাবে নিজেদের সঁপে দিয়েছি মোবাইলের হাতে। টিকটক, পরিচিতদের নিউজ ফিড, কিছু ভিডিও লিংক আর চ্যাটিংয়েই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি নিজেদের জীবন।

আমরা এখন যেখানে বাস করি, সেটি হচ্ছে প্রতিনিয়ত মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করার দুনিয়া। কিছু স্টাডি অনুযায়ী, প্রতিনিয়ত আমাদের ফোনে গড়ে ৬৩টির বেশি নোটিফিকেশন আসে। ই-মেইল ইনবক্সে এই সংখ্যাটি হচ্ছে ৯০। গড়ে প্রতি তিন মিনিটে আমরা কাজ পরিবর্তন করি। যার ফলে আমাদের দিনগুলো প্রোডাক্টিভ হচ্ছে না। এ আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সময় সাপেক্ষ এবং কঠোর সদিচ্ছা প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ হয়। সাধারণত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কেই ডোপামিন নিঃসরণ হয়। মানুষের মধ্যে এর পরিমাণ অনেক বেশি। ডোপামিন এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার। এটি মানুষের মধ্যে নতুন কিছু পাওয়া বা দেখার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। ঘন ঘন স্মার্টফোনের দিকে তাকানো এ আকাঙ্ক্ষার কারণেই ঘটে থাকে। ইন্টারনেটে পাওয়া নতুন নতুন উপাদান এই আকাঙ্ক্ষাকে আরও প্রবল করছে। দৈনিক ২-৩ ঘণ্টার বেশি মোবাইল ব্যবহারকারীদের ৩-৫ বছরের মধ্যে আংশিক বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া কানে হেডফোন লাগিয়ে যত্রতত্র চলাফেরায় প্রতিনিয়ত অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ একজন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর স্ক্রিনে ট্যাপ, ক্লিক ও সোয়াইপের পরিমাণ গড়ে ২ হাজার ৬১৭ বার এবং সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৪২৭ বার। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনে টাইপিংয়ের ফলে আঙুলের জয়েন্টে ব্যথা হয়। এর ফলে আর্থারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বসার ভঙ্গি, কাঁধ ও কানের মাঝামাঝি ফোন রেখে কথা বলা এবং অতিরিক্ত ঝুঁকে দীর্ঘক্ষণ মেসেজ টাইপিংয়ের কারণে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম উদ্ভাবন এই স্মার্টফোন। এটি গোটা বিশ্বকে একটি মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। কেউ চাইলে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। সব তথ্য চলে এসেছে হাতের কাছে। এই প্রযুক্তিকে অস্বীকার বা অবহেলা করার সুযোগ নেই। শুধু নিশ্চিত করতে হবে এর সীমিত এবং সঠিক ব্যবহার। ভুলে গেলে চলবে না, যোগাযোগ স্থাপন ছাড়াও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। এগুলো বাদ দিয়ে শুধু যোগাযোগ স্থাপন কিংবা বিনোদনের দিকে নজর দিলে জীবন অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোন আসক্তি থেকে দূরে রাখতে হবে যে কোনো মূল্যে। অভিভাবকের দায়িত্ব সন্তানদের সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে রাখা। নির্দিষ্ট বয়সের আগে কোনোভাবেই শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়া যাবে না।

যারা আসক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের কাউন্সিলিং করে ফিরাতে হবে। বাবা-মা এবং পরিবারের লোকদের আরও বেশি সময় দিতে হবে। অবসর বিনোদন হিসেবে স্মার্টফোনের পরিবর্তে তাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া কিংবা গল্পের বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। বাচ্চাদের বই পড়ার প্রতি আসক্ত করে তুলতে হবে। অনেক সময় শিশুর কান্না বা রাগ ভাঙাতে অভিভাবকরা মোবাইলে কার্টুন বা গান চালিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। এটি কিছুতেই করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, স্মার্টফোন আসক্তি রোধ করতে না পারলে, আমাদের একটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র, সমাজ বা পরিবারের জন্য বয়ে আনতে পারে ভয়ংকর পরিণতি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত