ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রয়োজন একটি বাসযোগ্য পরিবেশ

রেজাউল করিম, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, [email protected]
প্রয়োজন একটি বাসযোগ্য পরিবেশ

বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন একটি বাসযোগ্য পরিবেশ। কিন্তু পরিবেশটা ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। পরিবেশের সব ক’টি উপাদান আজ দূষণের কবলে। বুকভরা শ্বাস নিতে প্রয়োজন বিশুদ্ধ বাতাস। সেই বায়ুদূষণে আমরা শীর্ষে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের দূষণপ্রবণ এলাকাগুলোর প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছেন। ছোট হর্নের বড় আওয়াজে চারদিকে শব্দদূষণ। শহরাঞ্চলে গাড়িচালকরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। অন্যান্য শব্দ তো আছেই। কানের ভেতরে রিসেপ্টর প্রথমে শব্দ তরঙ্গকে ধারণ করে, তারপর ককলিয়ার নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। দীর্ঘদিন যারা অনেক শব্দের মধ্যে থাকেন, তারা ক্রমেই শ্রবণশক্তি হারাতে থাকেন। ইউএনইপির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকায় বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে শব্দের মাত্রা ১১৯ এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবল, যা একজন মানুষের সহ্য ক্ষমতার অনেক বেশি। মানুষের কান ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ সহ্য করতে পারে। এদিকে পানি দূষণে আমরা রোগাক্রান্ত। পৃথিবীর মোট পানির ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। বাকি ৩ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি। ৩ শতাংশের মধ্যে ভূগর্ভে ৩০.১ শতাংশ, আইস ক্যাপস ও গ্ল্যাসিয়ারসে ৬৮.৭ শতাংশ, ভূপৃষ্ঠে ০.৩ শতাংশ ও ০.৯ শতাংশ অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া যায়। নানাভাবে এই মহামূল্যবান পানি দূষিত হচ্ছে। অতিরিক্ত কীটনাশকে মাটি দূষণ হচ্ছে। উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলছে। রাসায়নিক বিষ মিশে উৎপাদিত ফসল হচ্ছে বিষ। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনে পাল্টে যাচ্ছে পরিবেশ ও বৈচিত্র্য। ষড়ঋতুর দেশ হচ্ছে তিন ঋতুতে।

সময়ের পরিবর্তনে মানুষের প্রয়োজনও বদলেছে। জনসংখ্যা বেড়েছে বহু গুণে। বেড়েছে চাহিদাও। শিল্প বিপ্লবের কারণে মানুষের চাহিদার বদলে গেছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশে। কারখানায় প্রস্তুত হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। নিষ্কাশন না করে সেই কারখানার বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে।

বর্জ্য পুড়িয়ে ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাসেও ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন সুবিধার জন্য যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে তা মাটির ক্ষতি করছে। এভাবে পরিবেশের প্রত্যেকটি উপাদান দূষিত হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে। পরিবেশের প্রতিটা উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। এ সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায়। ১২টি রাসায়নিক দ্রব্যের মধ্যে ৮টি কীটনাশক যেমন- অলড্রিন (aldrin), ডায়েলড্রিন (dieldrin), ক্লোরডেন (chlordane), এনড্রিন (endrin), হেপ্টাক্লোর (heptachlor), ডিডিটি (DDT), মিরেক্স (mirex), এবং টক্সাফেন (toxaphene)। দুটি শিল্পজাত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন পিসিবি (PCBs), হেক্সাক্লোরোবেনজিন (hexachlorobenzene)। আর অন্য দুটো হলো- কারখানায় উৎপাদিত অনাকাঙ্ক্ষিত উপজাত যেমন ডাইওক্সিন (dioxin) এবং ফিউরান (furan)। পরিবেশের সব ধরনের জীবজন্তুর ওপর প্রভাব ফেলে এই বিষাক্ত পদার্থগুলো।

এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। পরিবেশের দূষিত উপাদান আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সাগরের পানি দূষিত হওয়ায় বিপন্ন অনেক জলজ জীবন। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, মৌমাছির সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে। পরাগায়নের মাধ্যমে আমাদের বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে মৌমাছির বিকল্প নেই। তাদের এই দুরবস্থা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। আমরা যদি আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে আমরা বেশি দিন পৃথিবীতে টিকতে পারব না। পরিবেশ বাঁচাতে জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা কমবে। তাহলেই আমাদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে পারব।

একটি দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় সেখানকার পরিবেশ থাকবে ভারসাম্যহীন। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট ২০১৮) জানায়, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে ১৭ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) এবং ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) একটি প্রতিবেদনে জানায়, গত ৭ বছরে দেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে।

প্রাকৃতিক ভারসাম্যনির্ভর করে ওই দেশের বনাঞ্চলের ওপর। পরিবেশ দূষণের বহুবিধ কারণের মধ্যে বনাঞ্চল ধ্বংস অন্যতম। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ৫০ থেকে ৫০০ মিটার পরিমাণ একটি বনভূমি ৩ থেকে ৫০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা কমাতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে বনায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর যেসব স্থানে বন আছে- এর ভেতরের অংশের মানুষ, পশু ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অত্যন্ত কম। এছাড়া সমুদ্রের সৃষ্ট নিম্নচাপ যখন কোনো বিশাল বনভূমির কাছে আসে, তখন তা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে বিপুল পরিমাণ বনায়ন ধ্বংস করার ফলে পৃথিবীর আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে মাটির নিচে পানির বিশাল অস্তিত্ব, অকাল বর্ষণ, বর্ষায় শীতের হানা, শীতে খরার দাপট। অন্যদিকে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি সূর্য থেকে বিকীর্ণ অতি বেগুনি রশ্মির (UV ray) বড় রকমের অংশ ওজন স্তর (O3) শোষণ করায় গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিনই নির্বিচারে যে হারে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে, এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর। এভাবে চলতে থাকলে মরুভূমির বিস্তার ঘটবে। আবহাওয়াবিদ ও প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা স্পষ্টভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, বায়ুমণ্ডলের তাপবৃদ্ধি, ওজন স্তরের অশুভ পরিবর্তন, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেই বনায়ন বা বৃক্ষরাজির অনুপস্থিতির কারণ বিদ্যমান। সবকিছু মিলিয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে বাসযোগ্য পরিবেশ। বৃক্ষ রোপণের সুফলতা ও বৃক্ষনিধনের কুফলতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রতিটি ইটখোলায় জ্বালানি হিসেবে কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহার করতে হবে।

কিছু দিন ধরে তীব্র তাপদাহ চলছে। সামান্য বৃষ্টি হলেও তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটেনি। প্রচণ্ড এই তাপদাহের কারণে সারাবিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। বাংলাদেশেও এর ব্যপ্তয় ঘটেনি। ৫৮ বছরের ইতিহাসে দেশে এবারের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ। তাপমাত্রার এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির প্রভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। রাস্তার পিচ উঠে যাচ্ছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ (CO2), ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (CFC) নিঃসরণ ও অতিরিক্ত বননিধন-এর প্রধান কারণ। নগরায়ণ ও শিল্পায়নে বননিধন বন্ধ করতে হবে। গাছ ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) শোষণ করে নেয় এবং অক্সিজেন (O2) ত্যাগ করে। ভারসাম্য রক্ষায় মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে গাছ লাগানোর বিকল্প নেই। যতবেশি গাছ লাগানো হবে, ততবেশি কার্বন শোষিত হবে। বাড়তি জনসংখ্যার কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে উন্নয়নের জন্য বৃক্ষ নিধন হয়। সম্প্রতি দেখা দেখা গেছে, টাঙ্গাইল জেলা সদর সড়কের উন্নয়ন কাজে অসংখ্য পুরোনো গাছ কাটা হয়েছে। বাদ পড়েনি উদ্যানের গাছগুলোও। টাঙ্গাইল-আরিচা সড়কে প্রায় আড়াই হাজার পুরোনো গাছকাটা হচ্ছে। এমন চিত্র সারা দেশে। অথচ ভূখণ্ডে সবুজায়নের বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিক তাপদাহ দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের ফল। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। একই কারণে বৃষ্টিপাতও কমে যাচ্ছে। জলাধার কমে যাওয়া, জনসংখ্যা, শিল্পকারখানা, যানবাহন, ভবন, গ্লাস নির্মিত ভবন বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক যানজট ইত্যাদি কারণেও তাপদাহের মাত্রা বাড়ছে। গাছ না কেটেও উন্নয়ন সম্ভব। কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নকশা করার আগে গাছের কথা বিবেচনা করতে হবে। গাছ প্রকল্পে রেখেই নকশা করা সম্ভব।

অথবা প্রত্যেকটি গাছের বায়োমাস ও ইকোলজিক্যাল ভ্যালু মূল্যায়ন করে নতুন করে বৃক্ষায়ন করতে হবে। নতুন করে তৈরি বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত গ্লাস ও এসির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। কাচে ধারণ করা তাপ ও এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাপমাত্রা আরও বাড়ছে। দূষিত গ্যাস বায়ুতে অবস্থিত ধূলিকণা এবং গ্যাসীয় পদার্থগুলো সূর্যের তাপমাত্রাকে শোষণ করে তাপপ্রবাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে।

সালফার-ডাই অক্সাইড (SO2), নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO2), কার্বন মোনো অক্সাইড (CO), কার্বন-ডাই অক্সাইড (CO2) তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এভাবে হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট তাপমাত্রাকে বায়ুমণ্ডলে আবদ্ধ করে রেখে নগরের তাপমাত্রা বাড়াচ্ছে। গাছপালা কার্বন-ডাই অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে বাতাসে অক্সিজেন ছড়িয়ে আশপাশের এলাকা শীতল রাখে। বন উজাড় করায় বৃক্ষ কমে গিয়ে এখন অক্সিজেন, জলীয়বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা বেড়েছে। একটি গাছ গড়ে ৫০ বছরে যে উপাদান ও সেবা দিয়ে থাকে, তার আর্থিকমূল্য বিবেচনা করলে গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। একটি গাছ এক বছরে ১০টি এসির সমপরিমাণ শীতলতা দেয়, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে, ৬০ পাউন্ড ক্ষতিকর গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। এক হেক্টর সবুজ ভূমির উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ চলাকালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ৬৫০ কেজি বিশুদ্ধ অক্সিজেন প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়। এছাড়াও বৃক্ষরাজি আবহাওয়ার তাপমাত্রা হ্রাস করে, বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায় ও ভূমিক্ষয় রোধ করে। তাই পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত