শিশুশ্রম

প্রতিরোধে দরকার শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানবিক ও আইনগত দিক থেকে শিশুশ্রম অনুমোদনীয় না হলেও থেমে নেই এর বিস্তার। বরং পরিমাণগতভাবে বেড়েই চলেছে। করোনাকালে অনেক শিশু নতুন করে এ তালিকায় নাম লিখিয়েছে। যাদের থাকার কথা ছিল স্কুলের গণ্ডিতে, তারা এখন বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। উল্লেখ্য, প্রতিবছর বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। গতকাল উদযাপিত দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিশুর শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি।’ এমন একটি দিবস পালনের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয় শিশুশ্রমের ব্যাপকতা ও উৎকণ্ঠা। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, যখন কোনো শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে, তখন তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে। আমরা লক্ষ্য করছি, পথেঘাটে প্রচুর শিশু বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত। কেউ বোঝা বইছে, কেউ টোকাইয়ের কাজ করছে, ট্যাম্পো-বাসে, হেলপার-কন্ডাক্টরি করছে। দোকান কিংবা ফুটপাতে পণ্য বিক্রিতেও তারা নিয়োজিত। কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাদের দেদারসে দেখা যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের আইনও শিশুশ্রম সমর্থন করে না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে ‘শিশু’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন ব্যক্তি এবং ‘কিশোর’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে এবং ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন ব্যক্তি। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুসারে শিশুদের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে দেয়া যাবে না। কিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকের কাছ থেকে শিশু-কিশোরদের সক্ষমতা সনদ নিয়ে শর্তসাপেক্ষে হালকা কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে। বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে এসব বিধিবিধানকে কাগুজে কথকথাই মনে হবে। প্রকৃত তথ্য হলো, শিশুশ্রম আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য না হলেও আমাদের দেশের শিশুরা বাধ্য হয়ে কাজ করছে। সবশেষ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে, দেশে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ লাখ শিশু শ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তবে পর্যবেক্ষণে বলা যায়, শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আরও অধিক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে অনেক শিশু স্কুল ছেড়ে বিভিন্ন শ্রমে যুক্ত হয়েছে। আর অপরিপক্ব বয়সে কর্মযজ্ঞে যুক্ত হয়ে অনেক শিশুর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নসাৎ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন সরকার ঘোষিত ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক কারখানা যথাক্রমে ১ ও ৯ নম্বরে। এ ধরনের কারখানায় কাজ করলে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, আঙুলে দাদ, দুর্ঘটনাজনিত দৈহিক ক্ষত, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরোরোগ্য ব্যাধি, মূত্রাশয় ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তবে কাজটি অত্যন্ত কঠিন- এটাও মানতে হবে। সংগত কারণেই টেকসই পরিকল্পনা জরুরি। মুখ্যত, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণেই শিশুশ্রম বাড়ছে। তাই শিশুশ্রম প্রতিরোধে পরিবারের সক্ষমতার কথা ভাবতে হবে। অর্থাৎ দারিদ্র্য এবং সুযোগের অভাবের মতো যে কারণগুলোর জন্য শিশুরা শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে থাকে, সে সমস্যাগুলোরও সমাধান প্রয়োজন। আমাদের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত একটি শক্তিশালী শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা দরকার, যাতে সমাজকর্মীরা সব শিশু, পিতামাতা এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষায় যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।