ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মোবাইল ফোনের ব্যবহারে সাবধান

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
মোবাইল ফোনের ব্যবহারে সাবধান

মোবাইল ছাড়া এখন কারো এক মুহূর্ত চলে না। ক্রমশই মোবাইল-অন্ত জীবন হয়ে উঠেছে আমাদের। এমন দৃশ্য বিরল নয়, যেখানে বাড়ি ঢুকলেই দেখা যাচ্ছে সামনে খাবারভর্তি থালা থাকলেও মোবাইলে বুঁদ হয়ে আছে ছেলেমেয়েরা। এমনকি, বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য অনেক মা-বাবা নিজের সাধের মোবাইলটি অবলীলাক্রমে তুলে দিচ্ছেন। তাই খেতে খেতে ফোন, হাঁটতে হাঁটতে ফোন, শুয়ে শুয়ে ফোন। ফোন এখন সব সময়েই থাকছে ব্যবহারকারীর হাতে।

সাধারণ মানুষ বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে মোবাইল নিয়ে সবাই বুঁদ হয়ে থাকছেন। ইন্দ্রিয়ের সবটাই দখল করে নিচ্ছে মোবাইলের সব কেরামতি। কিন্তু অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার অজান্তে অসুখ ডেকে আনছে। সেটাকে কতজন গুরুত্ব দেয়। সাধারণত ফোন করা থেকে মেসেজ পাঠানো, ছবি শেয়ার করা, হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুক করা কত কিছু করা যায় ওই মোবাইল থেকে।

উল্লেখ্য, যে কোনো কাজ করতে গেলেই মোবাইল থেকে রেডিয়োওয়েভ এবং মাইক্রোওয়েভ নির্গত হতে থাকে। ওই তরঙ্গের মাত্রা প্রায় ৮০০ থেকে ২৬০০ মেগাহার্টজ। তবে দেশ আর ফোনের নেটওয়ার্কের শক্তির ওপরে নির্ভর করে এর ওঠানামা। আর ওই মাইক্রোওয়েভ থেকেই সব সমস্যার সূত্রপাত।

আলোর সাতরংকে বোঝাতে আমরা প্রায়শই বেনীআসহকলার উদাহরণ দিই। ভিভজিওর বা বেনীআসহকলার সাত রঙের মধ্যে তালের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। তাই এটা অনেক নিরাপদ। কিন্তু বেগুনি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ কম। তাই এই গাঢ় রঙে ক্ষতিটা বেশি। এর মধ্যে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের শরীরের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।

ভুললে চলবে না, তরঙ্গ যতই ছোট হবে তার প্রভাব ততই মানব শরীরে বেশি করে পড়ে। ঠিক যেমন আতসকাচে আলো পড়লে দিকে তার ফোকাসে থাকা কাগজে আগুন ধরে যায়। দেখা গেছে, মাইক্রোওয়েভ নির্দিষ্ট জায়গা আক্রমণ করতে সক্ষম। আর সেটা থেকেই ক্ষতির শুরু।

মোবাইলে সারাক্ষণ কথা বললে ক্যান্সার হয়। ফোনে সিনেমা দেখলে চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এমন অনেক প্রশ্ন আমজনতার মধ্যে প্রায়শই শোনা যায় বটে। কিন্তু কোনোটাই এখন বৈজ্ঞানিক ধারণা দিয়ে ১০০ শতাংশ সঠিক বলা যায়নি। তবে মোবাইল ফোনের মাইক্রোওয়েভ দিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত হানে তা এক প্রকার পরিষ্কার।

ওই ঘটনাটি ব্যাখ্যা করা যায় ‘ফ্লে এফেক্ট’ দিয়ে। কী রকম সেই পরীক্ষা। দেখবেন লাগাতার কোনো ভনভনি কিংবা মিনমিনে শব্দে মাথা ধরে যায়। ফোনের মাধ্যমে যে আওয়াজটা কানে আসে, একটু পুরো থেকে ফোন ধরলে কথা শোনা গেলেও ক্ষতিটি একটু কম হয়। গত শতকের শেষে আমেরিকান বিজ্ঞানী অ্যালান ফ্রে লক্ষ করেন, দূর থেকে মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে মানুষের মস্তিষ্কে আঘাত হানা যায়।

মোবাইলে আমরা যা শুনি, তা মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে আমাদের কানে পৌঁছায়। পরীক্ষায় ফ্রে দেখিয়েছেন ওই মোবাইল থেকে মাইক্রোওয়েভ সরাসরি পৌঁছে যায় মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব অংশে। মস্তিষ্ক তখন তা শনাক্ত করছে শব্দ হিসেবে। তাই এর থেকে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘসময় মোবাইলে কথা বললে এইভাবেই ক্ষতি হতে পারে ব্যক্তির শ্রবণেন্দ্রিয়তে।

চিকিৎসকদের মতে, মোবাইল থেকে যে বিকিরণ হয়, তা কিছুটা হলেও শরীরের ক্ষতি করে। অনেকক্ষণ মোবাইলে কথা বললে দেখা যায় ফোন আর কান দুই-ই গরম হয়ে ওঠে। তাই একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কথা না বলাটাই শ্রেয়। শরীর থেকে কিছুটা দূরে মোবাইল রাখলেই ভালো। রাস্তায় যাতায়াতের সময়ে হাতে না নিয়ে ব্যাগে মোবাইল নেওয়া খুব জরুরি।

চার্জ দেওয়ার সময় কখনোই মোবাইলে কথা বলা ঠিক নয়। কারণ সে সময় মোবাইলের চারপাশে একটা ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হয়। তাই চার্জ অফ করে কথা বলা উচিত। অনেক কাজ মোবাইলে করা যায়। আর তা করতে হলে সরাসরি মোবাইলের বদলে ব্লু-টুথে কথা বলা ভালো। অনেক সময় রাস্তায় বাইক আরোহীকে হেলমেটের মধ্যে মোবাইল ঢুকিয়ে কথা বলতে বলতে যেতে দেখা যায়। তারা কিন্তু অনায়াসেই ব্লু-টুথ ব্যবহার করলে কোনো ভয় থাকে না। মোবাইল বেশি ব্যবহার করলে বারবার সমস্যাও হতে পারে। অনেকে বা হাঁতে, অনেকে আবার ডান হাত দিয়েই মোবাইল ঘাঁটতে বেশি অভ্যস্ত। সারাক্ষণ মোবাইল স্কল করতে গিয়ে হাতের কয়েকটি বিশেষ আঙুলের ওপর চাপ পড়ে। অনেক সময় বেশিক্ষণ ধরে মোবাইলে সিনেমা বা চ্যাট করার সময় কনুই ভাঁজ করে রাখতে হয়। এতে কনুইয়ে ব্যথা হয়। মোবাইল বেশি ব্যবহার করলে হাতের কনিষ্ঠা ও অনামিকা অসাড় হতে পারে। মোবাইলে ছোটোদের ভিডিও গেম খেলার নেশা আরও ক্ষতি করে তাদের আঙুলের। যে সমস্যাটা এখন প্রায় দেখা দিচ্ছে তা হলো, চোখের সমস্যা। একটানা মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকলে চোখের বারোটা বাজবে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আড্ডা মারা কিংবা সিনেমা দেখাটা এর জন্য বেশি দায়ী। লাগাতার মোবাইলের উজ্জ্বল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ শুকিয়ে যায়। কম বয়সেই চোখে চশমা পড়ে। তবে ছোটদের ক্ষেত্রে চোখের সমস্যাটা বেশি হয়।

অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, মোবাইল নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে যাদের চোখের মাইনাস পাওয়ার তাদের পাওয়ার দ্রুত বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্রিন টাইম কমালে চশমার পাওয়ার বাড়ার হার কমে তবে রাতে অন্ধকারে ফোন দেখলে ক্ষতিটা আরও বাড়ে। সব মিলিয়ে মোবাইল নিয়ে সতর্ক থাকাতে কিছু সামান্য নিয়ম মেনে চলা উচিত।

যেমন-

টানা ফোনের দিকে না তাকিয়ে একই সঙ্গে চারপাশে তাকানোর অভ্যেস তৈরি করুন।

অনেকক্ষণ একটানা কথা বলতে হলে ব্লু-টুথ বা হেডফোনে কম ভলিউম দিয়ে কথা বলুন।

মাথার কাছে ফোন নিয়ে শোবেন না। ঘরে রাখলে তা কোনো ড্রয়ারের মধ্যে রাখুন।

বাচ্চাদের চুপ করে বসিয়ে রাখার জন্য মোবাইল হাতে তুলে দেবেন না। এর বদলে মোবাইলে গান চালিয়ে দিতে পারেন। এতে তাদের চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত