পাহাড়ে ভূমিধস

ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস এড়াতে হবে

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্ষা মৌসুম যতই এগিয়ে আসে, পার্বত্য জেলায় ততই ভূমিধসের আশঙ্কা বেড়ে চলে। কারণ প্রতিবছরই পাহাড়ধসের মতো ঘটনা ঘটছে, হতাহত হচ্ছে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছিল রাঙামাটিতে ২০১৭ সালের ১৩ জুন। গতকাল ঘটনার ছয় বছর পূর্ণ হয়। সেদিন তিন দিনের ভারী বৃষ্টি আর বজ্রপাতে রাঙামাটিতে ঘটে যায় স্মরণকালের পাহাড়ধসের ঘটনা। ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনায় পাঁচজন সেনাসদস্যসহ নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে শহরের মানিকছড়িতে একটি সেনাক্যাম্পের নিচে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের ওপর ধসে পড়া মাটি অপসারণ করতে গিয়ে ফের পাহাড় ধসের মাটিচাপা পড়ে নিহত হন ওই ক্যাম্পের দুই কর্মকর্তাসহ পাঁচ সেনাসদস্য। ভয়াবহ এই ভূমিধসে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মানিকছড়ি শালবাগান অংশে ১০০ মিটার রাস্তা সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে দীর্ঘ ৯ দিন সারা দেশের সঙ্গে রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে রাঙামাটির এত লোকের প্রাণহানি, ঘরবাড়ি, সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতের এত বড় ক্ষতি হবে- সেদিন কেউ ভাবতে পারেনি। সেদিন মুহূর্তেই সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল পর্যটন শহর রাঙামাটি। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে রাঙামাটিবাসীর মনে জেগে ওঠে আতঙ্কের সেই ভয়াল স্মৃতি। আর এই ঘটনার ছয় বছর পরও এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ায় ভারী বৃষ্টির আগাম সতর্কতায় সে আশঙ্কা সবাইকে ভাবাচ্ছে।

পরিতাপের বিষয়, রাঙামাটির পাহাড় ধসের ছয় বছর পার হলেও এখনো অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাহাড়ের নিচে যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি সত্ত্বেও মানুষের বসবাস কমেনি বরং আগের চেয়ে বেড়েছে। রীতিমতো ‘মৃত্যুকূপ’ জেনেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো আজও বাস করছেন পাহাড়ের গায়ে। পার্বত্য অন্য এলাকার অবস্থাও তথৈবচ। প্রতি বছরের মতো বর্ষার শুরুতেই এবারও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে ও উপজেলাগুলোতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের বৃষ্টির সময় নিরাপদে সরে যেতে ও আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের কেন সেখানে বিধিবহির্ভূতভাবে বসবাস করতে দেয়া হচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। অভিযোগ, পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরতদের সরাতে সারা বছর প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ থাকে না। বর্ষা মৌসুম এলেই শুরু হয় উচ্ছেদের তোড়জোড়। পাহাড় ধসে প্রাণহানি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস বন্ধে বিভিন্ন সময় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি নানা সুপারিশ করলেও এসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ না থাকায় প্রতি বছর পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন সংস্থা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চায়। কিন্তু প্রাণ যায় মানবসন্তানের। প্রতি বছর হতাহতের দায় কে নেবে- এমন প্রশ্নের উত্তর মেলে না কখনো।

রাঙামাটির পাহাড় ধসের পর ২০১৮ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটি একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে পাহাড় ধসের কারণ ও মোকাবিলার কিছু সুপারিশ প্রদান করা হয়। সেগুলো আদৌ আমলে নেয়া হয়েছে কি-না আমরা অবহিত নই। স্মর্তব্য, আমাদের দেশে পাহাড় ধস কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখার অবকাশ নেই, বরং মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপই অধিক দায়ী। স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া, আবার এদের সহায়তায় পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা ইটের ভাটার কারণে পাহাড় ধস হচ্ছে। অবৈধ বসতি স্থাপন ও অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন করাও ভূমিধসের কারণ। এই ধরনের কর্মকাণ্ড অবশ্যই রোধ করতে হবে। আর পাহাড়ের পাদদেশে যারা ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন, তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।