দুর্যোগ মোকাবিলায় দরকার স্থায়ী সমাধান
প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল, শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
‘বাংলাদেশ ও প্রাকৃতিক’ দুর্যোগ যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন আমাদের পিছু ছাড়ছেই না। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে যেসব দেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম কেন্দ্র বলা যায়। প্রতি বছর এখানে বিভিন্ন দুর্যোগ হানা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়েছে। ১৯৭০ সালের গ্রেট সাইক্লোন নামে পরিচিত ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বড় মাত্রার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেখেছে বাংলাদেশ। ১৯৭০, ১৯৮১, ১৯৯১, ২০০৭, ২০১৯, ২০২০, ২০২২ সালের ঝড়গুলো ছিল বেশ ভয়ংকর এবং সর্বশেষ এবারের ঘূর্ণিঝড় মোখার তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকতে ও দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজন পরিকল্পিত বনায়ন প্রকল্প। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, দেশের মোট জমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। তা না তাহলে সেখানকার পরিবেশ ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকবে। কিন্তু আমরা যে যেভাবে পারছি, নির্বিচারে গাছ কেটেই চলেছি, কেউ কখনোই গাছ লাগানোর কথা মাথায়ও আনছি না। এইভাবে চলতে থাকলে একটা সময় এসে বৃক্ষের অভাবে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অন্যতম একটা কারণ প্রকৃতিকে অতিষ্ঠ করে তোলা। নির্বিচারে গাছ কেটে যেখানে সেখানে দালানকোঠা তৈরি করে প্রকৃতির যে একটা স্বাভাবিকতা আছে তার বিরুদ্ধে গিয়ে বনায়ন ধ্বংস করে গাছপালার সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এতে করে প্রকৃতির স্বাভাবিক চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আর তখনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বনভূমি থাকলে একটা দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু আমরা বারংবার নিজেদের প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে নির্বিচারে গাছ কেটে পরিবেশের ক্ষতি করার পাশাপাশি নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনছি। পরিবেশবাদীদের ধারণা, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ মানুষের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হতে পারে।
দুর্যোগকালীন দেখা যায়, উপকূলীয় সাইক্লোন শেল্টারগুলো বসবাসের জন্য উপযোগী না। কোনটা ভেঙে পড়ছে, কোনটা ময়লা-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আবার কোথাও জনসংখ্যা অনুযায়ী সাইক্লোন শেল্টার অপ্রতুল। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাইক্লোন শেল্টার বৃদ্ধি করা হবে বা মানসম্মত করে তৈরি করা হবে। এমন আশ্বাস দেয়া হলেও বেশিরভাগ জায়গায় তা কার্যকর হয় না।
আমাদের দেশে দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে সংগঠন, সংস্থার সাহায্যের অভাব হয় না। বিভিন্নভাবে সংগঠন, সংস্থাগুলো দুর্যোগকবলিত মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে, এটি একটি ভালো দিক। তবে দুর্যোগের সময় বা দুর্যোগের পরবর্তী সময়ে অসহায় মানুষদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের জন্য স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান করা জরুরি। যাতে তারা দুর্যোগের সময় আশ্রয়স্থলের জন্য উদ্বিগ্ন না হয়ে পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিজেদের ঠিকানায় থাকতে পারে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাদের জন্য অস্থায়ী আবাসের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা দরকার। নদীর পাড়ের মানুষজন যাতে অন্যত্র স্থায়ীভাবে মাথাগোঁজার জায়গা পেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা উত্তম বলে মনে করি।
বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি, তার সমাধানে সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপ দরকার। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী, খাল, বিল, হাওর ও অন্যান্য জলাভূমি দখলমুক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শহরের আশপাশে জলাভূমি ভরাট করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রোধ করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ অনেক জেলা শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণে অসম্ভব। শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে এলাকাভিত্তিক সমাধান না খুঁজে পুরো নগরী এবং আশপাশের এলাকার জন্য পরিকল্পনা, সঠিক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। মোটকথা হলো- বন্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, সমাধান খুঁজতে হবে ব্যবস্থাপনায়।
আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় তাই প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়ে থাকে। তবে ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণনির্ভরতা থেকে সরে এসে দুর্যোগ সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন, টর্নেডো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমি ও পাহাড় ধস, অগ্নিকাণ্ড, নদীভাঙন ইত্যাদি এ দেশের জনগণের জীবন-জীবিকা, সহায়-সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদসহ পরিবেশের বিপুল ক্ষতিসাধন করছে। এতে রাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে খরচ হিসেবে ব্যয় করা হচ্ছে, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ ঘটার আগেই তা প্রতিরোধে গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করলে অধিক সুফল পাওয়া যাবে। এতে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় যেমন রোধ করা সম্ভব হবে, ঠিক তেমনি স্থায়ীভাবে দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।