আন্তর্জাতিক

পুতিন-এরদোয়ান সম্পর্ক ও পশ্চিমাদের অভিমান

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected]

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সমগ্র পশ্চিমা জগতের কাছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এখন আর্থ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে রীতিমতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপ কিংবা কর্মকাণ্ডের প্রতি আস্থা না রাখা যেমন বিপদের, তেমনি তাঁকে সম্পূর্ণ মুক্তহস্ত করে ছেড়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত সামলানো যাবে কি না, সেটা নিয়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রিসেপ তায়েপ এরদোগান। তিনি এবার দেশটির প্রায় শতকরা ৫৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাকে ঘিরে ক্রমেই বাড়ছে আরব দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনা। তুরস্ক এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ব্যাপারে আরব দেশের সরকার ও জনগণের এই বিপরীত অবস্থান উন্মোচিত হয়েছে অতি সম্প্রতি প্রকাশিত আরব জনমতের ওপর একটি ব্যাপক-ভিত্তিক জরিপের ফলাফলে। আরব বিশ্বের ১৩টি দেশে পরিচালিত হয় এই জনমত জরিপ। জানা গেছে, জরিপের ৫৮ শতাংশই মনে করেন, অন্য যেকোনো দেশের নীতির তুলনায় তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য নীতি আরব স্বার্থের পক্ষে। ফিলিস্তিন ইস্যু তো বটেই, এমনকি সিরিয়া এবং লিবিয়ায় তুরস্কের বিতর্কিত সামরিক হস্তক্ষেপও সিংহভাগ আরব জনগণ সমর্থন করছে। এশিয়া ও আফ্রিকায় আরব বিশ্বের ১৩টি আরব রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সাধারণ আরব জনগণের মনোভাব জানতে এই জরিপটি করেছে দোহা এবং বৈরুত ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ। গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি মনে করেন, তুরস্ক রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে সাধারণ আরব জনগণের বিরাট একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

তিনি বলেন, সন্দেহ নেই তুরস্কের গ্রহণযোগ্যতা, বিশেষ করে সাধারণ প্রান্তিক আরব জনগোষ্ঠীর কাছে, বাড়ছে এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার পেছনে তুরস্ক রাষ্ট্রের চেয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ভাবমূর্তি প্রধান ভূমিকা রাখছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান আবার ক্ষমতায়। নির্বাচনে জেতার পরপরই তাঁকে দ্রুত বিশ্বনেতাদের অনেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের বৈশ্বিক কৌশলগত তাৎপর্য কী, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তবে এই বিশ্বনেতাদের বাইরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হচ্ছেন আলাদা। তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্টকে উজ্জীবিত করতে এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে, ভোটের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার আগেই এরদোয়ানকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তুরস্কের যে নীতি রাশিয়ার বিশেষভাবে পছন্দ, তা হচ্ছে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর ক্রেমলিনকে একঘরে করে দিতে এরদোয়ানের অস্বীকৃতি। এমনকি ন্যাটোতে তুরস্কের মিত্ররা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরও এরদোয়ান সেই পথ ধরেননি। দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর পাঠানো বার্তাও বেশ উষ্ণ ছিল। ক্রেমলিনের প্রতি এরদোয়ানের সহানুভূতিশীল হওয়া এবং ক্ষমতার দুই দশকে ঘরের ভেতরে বাক্স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব টেনে ধরার বিষয়টি পশ্চিমা এই নেতাদের অপছন্দ হলেও দিন শেষে তুরস্ক তাঁদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। এরদোয়ান হচ্ছেন এমন এক নেতা, যিনি একই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন, আবার ইউক্রেনেও সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা ঘটিয়ে গম সরবরাহব্যবস্থা সচল করে সুনাম কুড়িয়েছেন, যে গমের ওপর বিশ্বের বড় একটি অংশ নির্ভরশীল।

একই সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছেন। একসময় তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যুক্ত করতে এরদোয়ান প্রবল উৎসাহী থাকলেও তাঁর বক্তব্য এখন, মেকিং তুর্কি গ্রেট অ্যাগেইন। এর জন্য তিনি তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও বেশি স্বতন্ত্র করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে তার মিত্রদের সঙ্গে অত্যন্ত লেনদেনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। সুইডেনকে ন্যাটোর সদস্য করতে তুরস্কের অনুমোদন লাগবে এবং এর জন্য এরদোয়ানকে রাজি করাতে হোয়াইট হাউসের ব্যাকুলতাও দেখা যায়। কারণ, বাল্টিক সাগরে অবস্থান জোরদার করতে ন্যাটোতে সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমারা মনে করে, তুরস্কে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে এরদোয়ানকে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সে কারণে সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে তুরস্কের নমনীয় হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে পশ্চিমারা। একমাত্র তুরস্ক আর হাঙ্গেরির কারণেই বিষয়টি আটকে আছে। এদিকে প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসন সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ব্যাপারে এরদোয়ানের কাছ থেকে আশ্বাস পেতে আগ্রহী।

২০১৫ সালে সৃষ্ট হওয়া এ সমস্যার ফলে ১০ লাখের বেশি শরণার্থী ও অভিবাসী মানব পাচারকারীদের সহায়তায় অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইইউ দেশগুলোতে ঢুকে পড়েন। মূলত বেশির ভাগই সিরীয় নাগরিক। এ নিয়ে ব্রাসেলস তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুসারে, তুরস্ক অর্থ সহায়তা পাবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে তুর্কি জনগণ ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুযোগ পাবে, তার বিনিময়ে এসব অবৈধ শরণার্থী ও অভিবাসীকে আটকাতে হবে। এ ব্যাপারে তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্রাসেলস আশা করে।

কিন্তু এরদোয়ান তাঁর সমালোচক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠালে ইইউ তাতে আপত্তি প্রকাশ করে। ফলে সেই চুক্তি পুরোপুরি কাজে আসেনি। এখন নিজেদের নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন আশা করছে, তুরস্ক শরণার্থীদের সিরিয়ায় জোরপূর্বক ফেরত পাঠাবে। যদিও ভূমধ্যসাগর দিয়ে নৌকা করে শরণার্থী ও অভিবাসীদের ইউরোপে পাঠানোর জন্য মানব পাচারকারীদের বাধা দেয় না তুরস্ক। ইজিয়ান সাগরকে কেন্দ্র করে গ্রিসের সঙ্গেও এরদোয়ান নানা বিরোধে জড়িয়ে আছেন। আর প্রায় ৫০ বছর আগে তুরস্কের আক্রমণের পর থেকে সাইপ্রাসে একটি বিভাজন তৈরি হয়ে আছে। সেখানে এরদোয়ান দুই রাষ্ট্রনীতির প্রস্তাব দিলেও সাইপ্রাস তা নিয়ে এখনো বিচলিত। ফলে এসব কারণেও ব্রাসেলস রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছে। পশ্চিমারা তুরস্কের কৌশলগত গুরুত্বকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সেতু হিসেবে বর্ণনা করত। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন তুরস্কের সেই মর্যাদা পাল্টে দিয়েছে। ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদে পদার্পণ করার মধ্য দিয়ে এরদোয়ানের কাছ থেকে পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের চমক আশা করছেন অনেকেই। তুরস্ক কী করে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। সাম্প্রতিক অর্থনীতির দুরবস্থার কথা এরদোয়ানের দল মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করার জন্য আরও এক মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। সম্প্রতি তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হলেও সার্বিকভাবে এরদোয়ানের আমলে বেকারত্ব কমেছে। ২০২২ সালে বেকারত্ব ছিল ১০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। বিশেষ করে সামরিক প্রযুক্তি খাতে উন্নতি হয়েছে নজর কাড়ার মতো। সামরিক সরঞ্জামের ৭০ শতাংশ তুরস্ক এ মুহূর্তে নিজেরাই উৎপাদন করছে। বিভিন্ন দেশ থেকে তুর্কি বংশোদ্ভূত প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। এরদোয়ানের আমলে শিক্ষার হার বেড়েছে। বেড়েছে মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও।

এ ছাড়া সম্প্রতি কৃষ্ণসাগরে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্যাসের সব ধরনের এক মাসের বিল মওকুফ করা হয়েছে এ ছাড়া আগামী এক বছর রান্না ও পানি গরমের জন্য গ্যাসের বিল দিতে হবে না। শুধু ঘর গরমের জন্য গ্যাসের বিল দিতে হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় এরদোয়ান দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই অর্থনৈতিক উন্নতি ও সাম্প্রতিক সময়ে বেতন-ভাতা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথাও বারবার উল্লেখ করেছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, অব্যাহতভাবে এসব প্রচারণার কারণে ভোটের আগে বিভিন্ন জনমত জরিপকে ছাপিয়ে ভোটের মাঠের চিত্র বদলে যায়। এভাবেই গত কয়েক বছরে সৃষ্টি হওয়া অনাস্থাকে কাটিয়ে ওঠেন এরদোয়ান। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র নীতিতে চিহ্নিত সবচেয়ে বড় ‘সংকট’ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও রয়েছে এরদোয়ানোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শুধু তা-ই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরাইলের সঙ্গে চাপানউতোর সম্পর্ক রাখার পাশাপাশি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ইরানের সঙ্গেও এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি বদলানোর বিষয়েও চাপ দিয়ে যাচ্ছেন এরদোয়ান। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হিসেবে পরিচিত কুর্দিদের ওপর সামরিক অভিযান চালাচ্ছেন, আবার প্রতিবেশী আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সংকটেও মধ্যস্থতা করছেন, যেখানে মস্কোর প্রভাবও রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায়ই প্রতীয়মান হয়, এরদোয়ান যেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সামনের দিনগুলো কেমন যাবে? তুরস্কবাসীকে মুক্ত নিশ্বাস নেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন দরকার, কেননা তুর্কি সমাজে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বদ্ধাবস্থায় পড়ে ধুঁকছে।

এরদোয়ান অঙ্গীকার করেছিলেন, নতুন তুরস্ক প্রতিষ্ঠার শততম বর্ষে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের মধ্যে তিনি তুরস্ককে পাল্টে দেবেন। সবার আশা ছিল, তুরস্ক ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর ১০টির মধ্যে একটি থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশটি এখন সবচেয়ে ধনী দেশের ২০টির মধ্যে ১৯ নম্বরে রয়েছে। গত তিন বছরে তুরস্কের অর্থনীতি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। লিরা ডলারের বিপরীতে মূল্য হারাচ্ছে। এ অবস্থায় এরদোয়ান তুরস্কের অর্থনীতির গতি ফেরাতে পারবেন কি-না এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট কতটা শক্তিশালী করতে পারেন এটাই দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব।