পরিবেশ রক্ষায় আগে নদী দূষণমুক্ত করা জরুরি

এম এ কাদের, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, [email protected]

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যে নদীর অপরূপ দৃশ্য দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠেছিলেন- ও নদীরে, একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে। বল কোথায় তোমার দেশ? তোমায় নেই কি চলার শেষ? দেশের সেই নদীগুলোর ওপর অত্যাচারের দূষণ চিত্র দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে গঙ্গার কাছে জানতে চান, তবুও তুমি বইছ কেন? (ভূপেন হাজারিকা)। দেশে নদ-নদী দখল ও দূষণের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দীর্ঘদিন ধরে এদিকে খেয়াল না দেওয়ায় দেশের ২৩০টি নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। এসব নদ-নদী, প্রায় ১০ হাজার প্রভাবশালী ভূমিদস্যু দখলবাজ দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আসছে। তাছাড়া নদীগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মিল-কলকারখানার বর্জ্য, নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা শহর, নগরের মানুষের ব্যবহারের দূষিত নোংরা পানি, শহর বাজারের (মাছ, মাংস বাজারের নোংরা বর্জ্য) ড্রেনে দীর্ঘদিন জমে থাকা দূষিত বর্জ্য সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযোগ রাখার কারনে সাংঘাতিকভাবে নদী দূষণ হচ্ছে। মৃতপ্রায় এ সব নদ-নদীগুলো দেখলে মনে হয় এ যেন বর্জ্য রাখার ভাগাড়। এসব নদ-নদী ধ্বংস করার পেছনে কাজ করছে এক ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সম্প্রতি সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ৪ ক্যাটাগরিতে ১ হাজার ৮৯ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে (সূত্র : সংবাদ ১৩-০৩-২০২০)। এতে বলা হয়েছে, নদ-নদী দখলবাজদের সঙ্গে অধিকাংশ স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা রয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় ক্ষমতাধর প্রভাবশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে।

নদীদূষণ ও দখল এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রায় প্রতিদিনই নদী দূষণের ও দখলের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে চোখে পড়ে। বিআইডবিউটিএর এসব বিষয়ে দেখভাল করার কথা থাকলেও তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে দখলদাররা নদী দখল অব্যাহত রেখেছে। সারা দেশে নদীনালা খাল-বিল অবৈধভাবে দখল হওয়ার কারণে পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ মিল-কলকারখানার বর্জ্য ও বসতবাড়ি, হাট-বাজারের নোংরা দূষিত পানি, মৃত প্রাণী, প্রাণীর পচা উচ্ছিষ্ট অংশ অহরহ নদ-নদীতে ফেলা হচ্ছে। শহর এলাকায় বস্তিবাসীদের অপরিকল্পিত অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ভবনের টয়লেট ড্রেনের সঙ্গে সংযোগ করে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদ-নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী ও জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। নদীদূষণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, বড় বড় শহরের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে খাল নদীর সঙ্গে সংযোগ রাখায়। ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষণ অস্বাস্থ্যকর বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও বিভিন্ন খাল ডোবার দিকে তাকালেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। এভাবে নদীদূষণ ও দখলের কারণে নদীগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। তাছাড়া নদীর প্রবাহ না থাকায় প্রতি বছরই বর্ষাকালে মারাত্মক বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীদূষণকারী শুধু প্রভাবশালী কলকারখানার মালিকরাই নয়, সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্নভাবে নদ-নদী দূষণ করছে। দেশের নদীগুলোর পাড়ে গড়ে ওঠা সিটি শহর ও শত শত পৌর এলাকায় বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া দেশে সুগারমিলগুলো অ-স্বাস্থ্যকর বর্জ্য, রোগ জীবাণু বহনকারী মশা-মাছির উপদ্রব ও বংশবিস্তারে সাহায্য করে। এই বর্জ্যগুলো ড্রেনগুলির মাধ্যমে সরাসরি নদীতে সংযোগ করা হয়, যা নদী দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। আর এই নদী দূষণই পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।

দেশের বেশির ভাগ মিল কলকারখানার বর্জ্য, নিজস্ব শোধনাগার না থাকায় দূষনকারীরা নদীগুলো কে তাদের নিজস্ব সম্পদ মনে করে নদী দূষণ করে পরিবেশ নষ্ট করছে। নদী দখল ও দূষণকারীরা এতই শক্তিশালী যে, রাষ্ট্্রীয় সব উদ্যোগ তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। তাছাড়া নদী দখল এবং দূষণ ঠেকানোর জন্য সরকারী যেসব সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়া আছে, দৃশ্যমান এসব অনিয়ম দেখেও তাদের চুপ থাকার রহস্য উন্মেচিত হওয়া দরকার। অনেক সময় আমরা দেখেছি, সরকারের পক্ষ থেকে নদ-নদীমুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে প্রভাবশালীদের বাধার সম্মুখীন হয়ে আর বেশিদূর এগোতে পারে না, থেমে যায়। ক্ষমতাশীল, প্রভাবশালীদের স্বার্থের কাছে নদী উদ্ধারের উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হোক দেশের ১৭ কোটি মানুষ তা আশা করে না।

নদী রক্ষায় শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। নদীর তিরে মিল-কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ইতিপূর্বে যেসব মিল-কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার নেই সেগুলোর শোধনাগার তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশের বড় বড় শহর, সিটি শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকার দূষিত বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত না করে শোধনাগারের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প নদীদূষণ ও পরিবেশ দূষণের কারণে বন্ধ করতে হবে অথবা নদীদূষণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। লঞ্চ-স্টিমার নির্মাণ ও মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পাড়ে তৈলাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।

পানিই জীবন, কথাটি মনে রেখে সর্বদা পানির প্রবাহ সচল রাখতে নদী খননের সঙ্গে সঙ্গে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নদী দূষণও ঠেকাতে হবে। যেহেতু ক্ষমতাবান প্রভাবশালীরা নদীকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, নদীগুলো উদ্ধারের কাজে সরকারের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে কাজকে বেগবান করতে পারলে, খননের সঙ্গে সঙ্গে নদীদূষণমুক্ত হলে দেশের ২৩০টি নদী বাঁচবে, জলজ প্রাণী বাঁচবে, পরিবেশ বাঁচবে, দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচবে।