ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পর্যালোচনা

হুন্ডি ঠেকাতে হবে সরকারের কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে

রেজাউল করিম খোকন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
হুন্ডি ঠেকাতে হবে সরকারের কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে

দেশে বর্তমানে যে ডলার-সংকট চলছে, তার জন্য সরকারের ভুল নীতি দায়ী বললেও অত্যুক্তি হবে না। এটিকে অর্থনীতির মৌলিক সংকট হিসেবে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দুটি প্রধান উপায় হলো পণ্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমাদের আমদানি খরচ বেশি। ফলে এই উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার বাড়ানোর সুযোগ কম। সে ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, প্রবাসী আয়ের একটা বড় অংশ আসে অবৈধ চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মালদ্বীপ থেকে ৬৬ শতাংশ শ্রমিক হুন্ডিতে টাকা পাঠান। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের ব্যাংক হিসাবই নেই। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক আছেন দুই লাখের মতো। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক এক কোটি। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসে, অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। এই হুন্ডি ব্যবসার পেছনে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি ও অর্থ পাচারই মূলত দায়ী। ডলারের বিনিময়ে টাকার মূল্যমান বাজারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, যার ফল হয়েছে হিতেবিপরীত। সরকারের বেঁধে দেয়া হারের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি। অনেক সময় সেটি ৬ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এই অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিকরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে বেশি উৎসাহী হন। সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়েও তাদের ব্যাংকমুখী করতে পারেনি। হুন্ডি ব্যবসা প্রসারের আরেকটি কারণ দেশ থেকে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার হওয়া। পাচারকারীরাই মূলত হুন্ডি ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগানদাতা। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। সরকার যতই প্রণোদনা দিক না কেন, বাইরের বাজারে তার চেয়ে বেশি দাম পেলে প্রবাসীরা সেখানেই ঝুঁকবেন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের বিকল্প নেই। ডলারের বিনিময় হার বাজারের হাতে ছেড়ে না দেয়ায় দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির দোহাই দিয়ে সরকার যে ৯-৬ সুদের হার বেঁধে দিয়েছিল, তাও কাজে লাগেনি। গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। অন্যদিকে ডলার-সংকটের কারণে অনেক জরুরি পণ্যের আমদানিও কমেছে। এই দাবদাহে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবনই শুধু বিপর্যস্ত হয়নি, শিল্পকারখানায় উৎপাদনও মারাত্মকভাবে কমেছে। বিশ্বব্যাংকও বলেছে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ডলার-সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপে পড়েছে। সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও এই চাপের কথা জানেন। আমরা মনে করি, সময়ক্ষেপণের আর সময় নেই। হুন্ডি ব্যবসার লাগাম টেনে ধরতে অর্থ পাচার যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি আলোচিত ইস্যু রিজার্ভ সংকট। রিজার্ভ সংকটের জন্য রপ্তানির থেকে আমদানি বেশি হওয়ার পাশাপাশি আলোচিত হচ্ছে দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টি। আর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই থামছে না হুন্ডির দৌরাত্ম্য। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার। হুন্ডিচক্রে বন্দি হয়ে পড়েছে বৈধপথের রেমিট্যান্স। এর ফলে অর্থ পাচারও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে প্রতি ডলারে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে, যা হুন্ডি প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বিমান চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় প্রবাসীরা অন্যজনের কাছেও নগদ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। ফলে রেমিট্যান্সে প্রণোদনার পরও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কমছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে রেমিট্যান্সে প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে সরকার। হুন্ডিচক্র বিদেশে ডলার বা অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা রেখে দেয় এবং তাদের এজেন্টরা দেশে সুবিধাভোগীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়। ফলে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতি বয়ে আনছে। সাধারণত বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। মূলত শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারের জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় কম মূল্য বা বেশি মূল্য দেখানো হয়। অর্থ পাচারের জন্য দেশের বাইরে যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে, তা হুন্ডিচক্র মেটায়। ব্যাংকিং চ্যানেলে কেউ পাঠালেও প্রবাসীর সুবিধাভোগী দেশে টাকা পান। বিদেশি হুন্ডি এজেন্ট প্রবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা কিনে এখানে টাকা পরিশোধ করে। ব্যবসার পাশাপাশি যারা বিদেশে বাড়ি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেন, তারা নানাভাবে হুন্ডি চক্রের দ্বারস্ত হন। করোনার কারণে হুন্ডি বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে। রেমিট্যান্স কমার অন্যতম কারণ হয়তো হুন্ডি। তবে শুধু একক কারণে রেমিট্যান্স কমছে না।

উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিল অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সঙ্গে। এ দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি। ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকত তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে। মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্র্যাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারতজুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানির সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।

হুন্ডি একটি বৈশ্বিক চক্র। ফলে সারাবিশ্ব থেকে প্রবাসীদের পাঠানোর অর্থ দেশে পরিজনদের পৌঁছে দেন। হুন্ডি কারবারিরা প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি করেন, অনেক সময় তারা ব্যাংকে যেতে পারেন না। আবার প্রবাসের সব শ্রমিকের বৈধ কাগজ নেই। যে কারণে চাইলেও অনেকে ব্যাংকে অর্থ পাঠাতে পারেন না। হুন্ডি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয় না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যযুগে ভারতে সম্পদ লেনদেনের জন্য প্রথম এই পদ্ধতির সূচনা হয়। বর্তমানে বৈধপদ্ধতি এড়িয়ে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা আনার কাজে হুন্ডি পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে যোগ হয়। কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়। এছাড়া রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময় মূল্য পান বলেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর দিকে আগ্রহী হন। এমনকি সরকার ঘোষিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা। এজন্যই ব্যাংকের বদলে হুন্ডির দিকে ঝুঁকছেন তারা। বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময় মূল্য কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। এতে ডলার কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের সময় ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিপরীতে হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে, পাশাপাশি তাদের দেয়া রেটও ব্যাংকের থেকে ভালো। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ। একটা সময় হুন্ডি ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় লেনদেনকারীদের জন্য তা এখন অনেকটাই ঝাঁমেলামুক্ত। বিদেশে বসে দেশে পরিজনদের কাছে টাকা পাঠানো শুধু একটা ফোনকলের ব্যাপার মাত্র। বিদেশের কর্মস্থল থেকে এজেন্টকে ফোন দিয়ে পরিমাণ বলে দিলেই তারা সমপরিমাণ টাকা পৌঁছে দিয়ে আসেন গ্রাহকের স্বজনের কাছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সেবা। এছাড়া গ্রামে বা শহরে একেবারে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়েও হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেন হুন্ডির কারবারিরা। বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় দেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে চান, হুন্ডির কারবারিরা তা হাতে হাতে সংগ্রহ করে। কিন্তু ওই অর্থ দেশে আসে না। বিদেশে ওই অর্থ তুলে দেয়া হয়, দেশের টাকা পাচারকারীদের প্রতিনিধিদের হাতে। দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করেন তারা হুন্ডি চক্রের কাছে অর্থ দিয়ে দেন। আর হুন্ডি চক্র সমপরিমাণ টাকা তুলে দেয় বিদেশে টাকা পাচারকারীদের প্রতিনিধির কাছে। যে টাকা আবার তারা সংগ্রহ করেন দেশে টাকা পাঠাতে চাওয়া প্রবাসীদের থেকে। পক্ষান্তরে ব্যাংকে প্রবাসী আয়ের অর্থ ভাঙাতে গেলে গ্রাহকদের পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। অনেক সময় বৈধ পরিচয়পত্র-এনআইডি না থাকা, পরিচয়পত্র বহনের সচেতনতার অভাবও ব্যাংক থেকে প্রবাসী আয় ওঠানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা। হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর কোনো ফি নেই, বিপরীতে ব্যাংকে চার্জ কাটা হয় না। অনেক সময় বৈধপথে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো হলেও ব্যাংক থেকে তার স্বজনের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয় না। প্রবাসীরা ফোন করে জানানোর পর তারা ব্যাংকে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় কাউন্টারে। টাকাও পান হুন্ডির রেটের চেয়ে অনেক কম। প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে ব্যাংকে ফরম পূরণ করতে হয়, অনেক সময় কাগজপত্রও দিতে হয়। এতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের কথাও বোঝা যায় না। রেমিট্যান্স পাঠাতে অনেকটা সময় চলে যাওয়ায় অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে দেরি হয় তাদের। সামগ্রিকভাবে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রতি উৎসাহী। আরব আমিরাতের দুবাই, শারজা ও আবুধাবিতে কর্মরত আছেন হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক। তারা দেশে টাকা পাঠাতে আলাদা কোনো ছুটি পান না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাপস ব্যবহার করে নিজের অ্যাকাউন্ট প্রবাসে বসেই পরিচালনা করতে পারেন। প্রবাসী শ্রমিকরা অ্যাপস ব্যবহারে এখনও অনেক পিছিয়ে আছেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ভয়ও কাজ করে। এ জন্য তারা এক্সচেঞ্জ হাউসে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেন না। বাসার পাশেই হুন্ডি করার সুযোগ আছে, এটাই সহজ পথ। আবার এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে পাঠালে যেখানে প্রতি দিরহামে পাওয়া যায় ২৯ টাকা ২০ পয়সা, সেখানে হুন্ডিতে মেলে ৩১ টাকার বেশি। দুই টাকা বেশি পেতে তারা হুন্ডিতে টাকা পাঠান। দুবাইয়ের ডেইরা, লেবার ক্যাম্পুসংলগ্ন মার্কেট ও সবজি বাজার, আবুধাবির আল আইন; শারজার রোলা; আজমানের সবজি বাজার ও লেবার ক্যাম্প প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক থাকেন। প্রতিটি জায়গাতেই রয়েছে হুন্ডি করার ব্যবস্থা। ব্যাংকে হয়রানির পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত রেট পান না তারা। পাশাপাশি বিদেশ থেকে টাকা আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কাছে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয় তাদের। অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা হুন্ডি ছাড়া দেশে টাকা পাঠাতে পারেন না। বিদেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী শ্রমিকরই বৈধ কাগজ নেই। ফলে তারা নিজেদের ডকুমেনট দিয়ে ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে দেশে টাকা পাঠাতে তাদের সহজ সমাধান হুন্ডি। বিমানবন্দরগুলোতে প্রবাসীদের সঙ্গে মার্জিত ব্যবহার করা হয় না। হয়রানির কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের প্রতি প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের ঘৃণা ও আতঙ্ক বিরাজ করে। অনেক প্রবাসীই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে এর নীরব প্রতিবাদ জানান। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে বিস্তার লাভ করছে হুন্ডি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি সম্প্রতি জানিয়েছে, বিভিন্ন মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। হুন্ডির মাধ্যমে (প্রবাসীদের ভাষায় মোবাইল ফোনে) আসা অর্থ দেশে তাদের পরিবারের বিকাশ, রকেট ও নগদ-এসব মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবে পাঠিয়ে দেয় হুন্ডি চক্রের এদেশীয় অংশীদাররা। ২০২০ সালে করোনায় বন্ধের মধ্যে প্রবাসীদের আয় কমেছিল। অথচ রেমিট্যান্স ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। ওই বৃদ্ধি ছিল ক্ষণস্থায়ী। মূলত হুন্ডি চাহিদা কম থাকায় তখন প্রবাসী আয়ের প্রায় পুরোটা বৈধ চ্যানেলে এসেছিল। এ ছাড়া ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্যও বিদেশে যাওয়া বন্ধ ছিল। ফলে ডলারের চাহিদা ছিল কম। এখন সব খুলে দেয়ায় চাহিদা বেড়েছে। এতে হুন্ডিও বেশি হচ্ছে।

এ যাবতকালের মধ্যে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স দুই হাজার কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে করোনায় বিশ্বব্যাপী লকডাউনের মধ্যে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। অথচ ওই সময় বিশ্বের অনেক দেশে আয় কমেছিল। প্রবাসীদের একটি অংশ কাজ হারিয়ে কিংবা করোনা পরিস্থিতিতে ছুটি নিয়ে দেশে চলে আসে। নতুন করে বিদেশে যাওয়াও বন্ধ ছিল। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ব্যাপক কমে যায়। তখন হুন্ডি প্রবণতা কমানোর উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি লেখে সরকার। পাশাপাশি রেমিট্যান্স কমার কারণ অনুসন্ধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৭ সালের শুরুর দিকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে দুটি টিম পাঠায়। ওই প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে রেমিট্যান্স কমার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বাইরে বেশি অর্থ পাওয়া। তখন রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো ও অর্থ পাচার ঠেকাতে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ না কমিয়ে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়। কঠোর নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে হুন্ডির চাহিদা বন্ধ না করা গেলে অবৈধপথে অর্থ আনা ঠেকানো যাবে না। পাশাপাশি শুধু প্রণোদনা না দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমাতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত