মানুষ হয়ে ওঠাই হোক লেখাপড়ার উদ্দেশ্য

ইসরাত জাহান, শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে মহান রাব্বুল আলামিন জ্ঞান, দক্ষতা, বিবেচনা বোধ দেননি, যা মানুষের মধ্যে দিয়েছেন। মানুষের মাঝে যে মেধা রয়েছে তা কাজে লাগিয়েই সুন্দর জীবনধারা তৈরি করে তারা। মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্যত্বের বোধ উপলব্ধি করতে পারে না, তা জাগিয়ে তুলতে হয়। তার একটি মাধ্যম লেখাপড়া। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের বিবেচনা বোধ জাগিয়ে তুলতে পারি, জ্ঞান অর্জন করে তা চলার পথে প্রয়োগ করতে পারি, জানতে পারি ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-ভুল, ভালো-খারাপ এর মধ্যে তফাৎ কি। লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য এসব হলেও বর্তমানে তা সার্টিফিকেট অর্জনের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পেতে হবে, এমন লক্ষ্য মাথায় রেখেই পড়ালেখা করে মানুষ, যা গঁদ বাধা পাঠ্যপুস্তক পড়া এবং সেটা পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। বইয়ের পাতায় কি বলছে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার তাগিদ বা তাড়না কোনোটাই আমাদের নেই। এ যেমন সদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা সব পাপের মা। এগুলো পাঠ করে এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে সার্টিফিকেট অর্জন ব্যতীতের বাস্তব চর্চা কেউ করে না। কারণ তার কাছে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের চিন্তাই দৃঢ়। ফলে মানুষ হিসেবে গড়ার চেয়ে চাকরিওয়ালা হওয়াটাই তখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যার দরুণ মানুষের মধ্যে দেখা দেয় মূল্যবোধের অভাব, সংকীর্ণ মানসিকতা, মনুষ্যত্বহীনতা। এসব কারণে মানুষ খুব সহজে নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে জড়িয়ে পড়ে সহিংসতা, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদিতে।

সূর্য পূর্বদিকে উদয় হয় এটা যেমন সত্য, আমাদের দেশে লেখাপড়া শুধু চাকরির জন্য করা হয় এটাও তেমন সত্য। আমাদের বাবা-মা আমাদের পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থান নেয়। এটার কারণ ‘ভয়’। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র। তারা চায় না যে, তারা যেরকম অর্থ সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, তাদের সন্তানরা সেটার মধ্য দিয়ে যাক এবং তার একমাত্র সমাধান হিসেবে তারা বেছে নেয় লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করা। একটি কমন ডায়লগ আছে ‘লেখাপড়া করবি না তো কি রিকশা চালাবি?’ আমাদের দেশে জেনারেল নাইনে লেখাপড়া করার আসল উদ্দেশ্যই চাকরি করা। কয়েকজন হয়তো প্রফেশনাল লেভেলে সিঙ্গার, ক্রিকেটার তারপরেও পড়াশোনা করছে। তাদের হিসাব আলাদা, ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ হয় না। আমি ৯৫ শতাংশ জনসংখ্যার কথা বলছি।

আমাদের লেখাপড়ার দরকার আছে, শিক্ষিত হওয়ারও প্রয়োজন আছে। তবে যেটা জীবিকা নির্বাহের জন্য লেখাপড়া করা হয়, সেটা আসলে লেখাপড়া নয়। সেটাকে ট্রেনিং নেয়া বা স্কিল অর্জন করা বলা যেতে পারে। যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেকচার ইত্যাদি।

মনুষ্যত্ব বিকাশ, মূল্যবোধ অর্জন এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জনের জন্য যে লেখাপড়া করা হয়, সেটাই আসল শিক্ষা। আমার মতে, নৈতিক শিক্ষাই একমাত্র এবং ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র মেরুদণ্ড বিনির্মাণে প্রধান শিক্ষা। এ বিষয়ে লেখাপড়া করার প্রয়োজন আছে। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার রডের পরিবর্তে বাঁশ দেবে, ডাক্তার বিনা প্রয়োজনে হাজার হাজার টাকার টেস্ট করতে বলবে।

একটা দেশকে এগিয়ে নিতে, মানুষের মধ্যে ঐক্যজোট গড়তে, সুশীল সমাজ গড়তে, মানবসেবা করতে, পরার্থে জীবনদান করতে লেখাপড়ার মূখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। তবেই মানুষ আচরণে পশুত্বের পরিচয় দেবে না, মানুষে মানুষে সহিংসতা তৈরি হবে না, দেশের ক্ষতির স্বার্থে নিজেকে ভুল প্রয়োগ করবে না। এসব নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রয়োজন দেশের মানুষদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, যাতে করে তারা চাকরির তাড়নায় পড়ালেখা না করে, প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে, জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে পড়াশোনা করবে।