আন্তর্জাতিক যোগ দিবস

যোগের মহিমা

শচীন্দ্র নাথ হালদার, অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভস

প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

যোগ মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। এটি মানব জাতির অনেক কল্যাণ সাধন করতে পারে। যোগের মহিমা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। চার হাজার বছরের বেশি আগে ঋষি পতাঞ্জলি এ যোগ আবিষ্কার করেন। তার এ আবিষ্কার ‘পাতাঞ্জল সূত্র’ নামে পরিচিত। এ মহৎ আবিষ্কার অধিকারিক যোগীদের কৃপণ মানসিকতার জন্য জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেনি। যোগীরা সাধারণত উপযুক্ত পুত্র বা শিষ্য ছাড়া অন্য কাউকে এ যোগ শিক্ষা দিতেন না। কালক্রমে এ যোগ প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার কারণে জনসাধারণ যোগের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আধুনিককালে স্বামী বিবেকানন্দ মানবকল্যাণের জন্য যোগকে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন। এর ধারাবাহিকতায় ২১ জুন বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। যোগ অনুশীলনে প্রধানত নিরোগ, সবল, কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ, মনের নিয়ন্ত্রণ শক্তি অর্জন, জ্ঞানার্জন, ধার্মিক হওয়া, ধর্মের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান এবং মুক্তি লাভ করা সম্ভব।

যোগ বলতে আমরা সাধারণত রাজযোগ বুঝে থাকি। রাজযোগকে আট ভাগে ভাগ করা যায় যথা : যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি। যম বলতে অহিংসা, সত্য, অন্ত্রেয়, অচৌর্য, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহকে বুঝায়। এ যম ধারা চিত্তশুদ্ধ হয় এবং দেহ, মন ও আত্মা আনন্দে ভরে ওঠে। অন্য কোনো প্রাণীকে ক্ষতি না করাকে অহিংসা বলে। অহিংসা অপেক্ষা মহত্তর কোনো ধর্ম নেই। সত্যের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের কর্মের ফল লাভ করে থাকি। এ সত্যের ভেতর থেকে সব কিছু পাওয়া যায়। সবকিছু সত্যেই প্রতিষ্ঠিত। চুরি বা বলপূর্বক অন্যের জিনিস গ্রহণ না করাকে অস্তেয় বলে। কায়মনোবাক্যে সর্বদা সব অবস্থায় পবিত্রতা রক্ষা করাকে ব্রহ্মচর্য বলে। অপরের দান গ্রহণ না করাকে অপরিগ্রহ বলে। নিয়ম শব্দের অর্থ নিয়মিত অভ্যাস বা ব্রত পালন। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সব ধরনের শৌচই সাধনের জন্য প্রয়োজন। যম ও নিয়ম চরিত্র গঠনের সহায়ক। আসন বলতে আমরা ধ্যানাসন এবং স্বাস্থ্যাসন এ দুই ধরনের আসন বুঝে থাকি। বুক, গ্রিবা ও মাথা সমান রেখে দীর্ঘক্ষণ আরামে বসে থাকার অবস্থাকে আসন বলে।

প্রাণায়াম শক্তি অর্জনের উপায়। শ্বাস-প্রশ্রাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টাই প্রাণায়াম। প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রাণায়ামে মনশক্তিরূপ প্রাণের বিকাশসমূহকে মানসিক উপায়ের ধারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন প্রাণায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে যোগী অষ্টসিদ্ধি লাভ করতে পারেন। অষ্টসিদ্ধি হলো অনিমা, লঘিমা, গরিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাল্য, বশিত্ব ও ঈশিত্ব। অষ্টসিদ্ধি লাভ হলে সাধকের কাছে অনন্ত শক্তির দরজা খুলে যায়। তার কথায় মৃতদেহেও প্রাণের সঞ্চার হতে পারে। আমাদের দেহে পাঁচ ধরনের বায়ু কাজ করে। যথা : প্রাণ, অপ্রাণ, সমান, ব্যান ও উদান। নাভিমূলে সমান বায়ুর অবস্থান। নাভির উপরে প্রাণবায়ু এবং নাভির নিচে অপ্রাণ বায়ুর অবস্থান। সিদ্ধ যোগী প্রাণবায়ুর সঙ্গে অপ্রাণ বায়ুর মিলন ঘটিয়ে ইচ্ছামৃত্যু লাভ করতে পারেন। অরিষ্ট নামক মৃত্যুলক্ষণগুলোর ওপর মনোসংযোগ করে তিনি মৃত্যুর ক্ষণ জানতে পারেন। প্রাণকে যিনি জয় করেছেন পুরো জগৎ তিনি জয় করেছেন। জগতের সব শক্তি ক্রীতদাসের মতো যোগীর আদেশ পালন করেন।

বিষয়াভিমুখী মনের গতি ফিরিয়ে অন্তর্মুখী করাকে প্রত্যাহার বলে। চিন্তার একমুখীতাই ধ্যান। এ ধ্যানাবস্থাই মানব জীবনের সর্বোচ্চ অবস্থা। যতক্ষণ আমাদের কামনা বাসনা থাকে, ততক্ষণ আমরা প্রকৃত সুখ পাই না। শুধু ধ্যানভাবে সাক্ষীরূপে সবকিছু পর্যালোচনা করতে পারলেই আমরা প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারি। ইতর প্রাণীর সুখ ইন্দ্রিয়ে, মানুষের সুখ বুদ্ধিতে এবং দেবমানব ধ্যানেই সুখ লাভ করে থাকে। মনের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে স্থায়ীভাবে ধারণ করাকে ধারণা বলে। দীর্ঘস্থায়ী গভীর ধ্যানকে সমাধি বলে। সমাধি অবস্থায় সাধক জ্ঞানভূমি স্পর্শ করতে পারেন। আমাদের অধিকাংশ জ্ঞানই যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞান। এতে সত্য এবং অসত্যের মিশ্রণ থাকে। কিন্তু সমাধির জ্ঞান নির্ভেজাল সত্য জ্ঞান। সমাধিতে গিয়ে সাধক মহাজ্ঞানী হয়ে উঠতে পরেন। এ সমাধিতেই সাধক অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দেখে থাকেন। তিনি তখন অতীতের বারবার জন্মমৃত্যুর বিষয়াদি অবলোকন করে মুক্তিকামী হয়ে ওঠেন। সমগ্র মন যখন একটি মাত্র তরঙ্গে পরিণত হয়, মনের এ একরূপতার নামই ধ্যান।

মানবদেহ একটি জটিল বায়োকেমিক্যাল সংমিশ্রণে পরিচালিত হয়। দেহের অসংখ্য গ্রন্থি বা অর্গান থেকে অসংখ্য ধরনের রস নির্গত হয়ে দেহকে পরিচালিত করে। সঠিকভাবে এবং সঠিক পরিমাণে রস নির্গত হলেই আমরা স্বাস্থ্যবান থাকি এবং এর অন্যথা হলেই আমরা রোগাক্রান্ত হই। যোগ মন নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মন আত্মার যন্ত্রস্বরূপ এবং এ মন দ্বারাই আত্মা বাইরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকে। মনের আবার অন্তর্দৃষ্টি আছে এবং এ শক্তির সাহায্যে সাধন নিজ অন্তরের গভীরতম বিষয়গুলো দেখতে পারে। এ অন্তর্দৃষ্টি শক্তি লাভ করাই যোগীর উদ্দেশ্যে। সাধারণ মানুষের মন বহির্মুখী। পঞ্চইন্দ্রিয় এবং ষড়রিপুর তাড়নায় অনবরত বানরের মতো লাফাচ্ছে। বানরকে মদ খাওয়ালে, বিছুটিকায় কামড়ালে এবং তার মধ্যে অশরীরী প্রভাবে যে ধরনের চঞ্চলতা দেখা দেয়, মানুষের মনও তেমনি অহংকার, লোভ এবং পরশ্রীকাতরতার কারণে সর্বদা অস্থির থাকে। এ মনকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। কিন্তু যোগী দীর্ঘ সময় যোগসাধনার দ্বারা বহির্মুখী মনকে অন্তর্মুখী করে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যোগীরা বিশ্বাস করেন যে, মনের শক্তি অপরিসীম। এ মনোশক্তি প্রয়োগ করেই যোগী নিজেকে সুস্থ করতে পারেন। শক্তির অসামঞ্জস্যতাই রোগ। অন্তর্মুখী মনের মাধ্যমে যোগী শরীরের যে অংশে শক্তির অভাব আছে তা পূরণের ফলে তার দেহ সুস্থ হয়ে ওঠে।

জ্ঞানার্জন মানব জীবনের অন্যতম একটি সেরা কাজ। যোগী ধ্যানের মাধ্যমে এ জ্ঞানার্জন করে থাকেন। গভীর ধ্যানকে সমাধি বলে এবং এ সমাধিতে গিয়েই যোগী জগতের সত্যগুলো দর্শন করে থাকেন। মূর্খও যদি সমাধিতে যায় তবে সমাধি ভঙ্গের পর তিনি মহাজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারেন। যোগী সাতটি পর্যায়ে এ উচ্চতর জ্ঞান লাভ করে থাকেন। যখন জ্ঞান লাভ হতে থাকে তখন একটির পর আর একটি করে সাতটি স্তরে এ জ্ঞান আসতে থাকে।

মানব জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আধ্যাতিক সাধনা। শক্তির দুটি রূপ। পাশবিক রূপ এবং আধ্যাত্মিক রূপ। পাশবিক শক্তির গতি নিম্নমুখী এবং আধ্যাতিক শক্তির গতি ঊর্ধ্বমুখী। মেরুদণ্ডের নিম্নাংশের সামান্য নিচে কুলকুণ্ডলিনী বা মূলাধারের অবস্থান এবং দেহের শক্তির কেন্দ্র এ মূলাধার। মূলাধারে দেহের সব শক্তি সুপ্তাবস্থায় সঞ্চিত থাকে। আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে তিনটি নাড়ি আছে। মেরুদণ্ডের বাম দিকে ইড়া (চন্দ্রনাড়ি) এবং ডানদিকে পিঙ্গলা (সূর্যনাড়ি) এবং মেরুদণ্ডের মাঝখানে সুসুর্মা নাড়ির অবস্থান। ইড়া এবং পিঙ্গলা আজ্ঞাবাহী নাড়ি এবং মস্কিষ্কের আদেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেহের মধ্যে এগুলো কাজ করে। সাধারণ মানুষের দেহে সুসুর্মা নাড়ির কোনো কার্যকারিতা নেই এবং এর নিম্নাংশ বদ্ধ থাকে। যোগীরা যোগসাধনার দ্বারা সুসুর্মা নাড়ির নিম্নাংশ খুলে ফেলেন এবং শক্তি ঊর্ধ্বমুখে চালিত করেন। মূলাধার থেকে মাথা পর্যন্ত মেরু- সংলগ্ন আটটি চক্র আছে। সর্বনিম্নে মূলাধার চক্র, তারপর স্বাধিষ্ঠান চক্র, মণিপুর চক্র, অনাহত চক্র, বিশুদ্ধ চক্র, আজ্ঞাচক্র, ললনাচক্র এবং মাথায় সহস্রদলচক্র। নিম্নভূমি মূলাধার চক্র থেকে সর্বোচ্চ সহস্যদল চক্রে পৌঁছলে পাশবিক শক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়। মানুষের অধ্যাত্মিক শক্তিই এ ওজঃশক্তি। মানুষের জ্যোতির্ময় দেহের কারণও এ ওজঃশক্তি। কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিত করাই দিব্যজ্ঞান, জ্ঞানতীত অনুভূতি বা আত্মানুভূতি লাভের একমাত্র উপায়। কেউ সৃষ্টিকর্তার প্রেমে, কেউ সিদ্ধ মহাপুরুষের কৃপায় আবার কেই সূক্ষ্ম জ্ঞানবিচার দ্বারা কুণ্ডলিনী জাগরিত করেন।

পতিটি ধর্মই কতগুলো বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ বিশ্বাসের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারা যায় না। কিন্তু রাজযোগ ধর্মবিজ্ঞান। ধর্মের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখা দিতে রাজযোগ সমর্থ। পদার্থ বিজ্ঞান যেমন বাহ্য উপায়ের দ্বারা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়, তেমনি রাজযোগ অন্তঃশক্তি মনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিতে বাহ্য বা অভ্যন্তরীণ বলে কিছু নেই। বাহ্যপ্রকৃতি অন্তঃপ্রকৃতি একটি প্রতিবিম্ব মাত্র।

আজ ২১ জুন ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’। পৃথিবীর সব দেশেই এ দিবস পালিত হচ্ছে। যোগের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করাই আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের উদ্দেশ্য। এ বছর সৌদি আরব সরকার তাদের দেশের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যোগ অনুশীলন বাধ্যতামূলক করেছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে যোগ অনুশীলনে মানুষের আগ্রহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষ যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে দিব্য, যোগ্যময় জীবনযাপন করে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম দেহ এবং দীর্ঘজীবন লাভ করুক- ‘আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’-এ এটাই প্রত্যাশা।