আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

সামছুল আলম দুদু এমপি, রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে আড়ম্বরপূর্ণ সম্মেলনের মাধ্যমে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদন নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। দলটিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিকশিত করতে নেতৃবৃন্দ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৫৪ সলে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে প্রদেশে ক্ষমতার অনুশীলন করতে গিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ উপলব্ধি করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়। এই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ছাড়া রাজনীতি এগুবে না। সে জন্য ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত আগ্রহ এবং প্রজ্ঞাবান দৃষ্টিভঙ্গিই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয় দলটি। যাত্রা শুরু হয় এখান থেকেই। বঙ্গবন্ধু দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করে আওয়ামী লীগকে একটি গণমুখী রাজনৈতিক দলে পরিণত করেন। তিনি ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আওয়ামী লীগকে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম হন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দমনপীড়নের পথ অনুসরণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে অধিকার সচেতন করে তোলেন। ঘুমন্ত বাঙালি যেন জেগে ওঠে। নানাভাবে বঞ্চনার শিকার বাঙালিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তাই সংগঠনকে শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পৃথিবীতে যে কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে বিশেষ কোনো লক্ষ্যকে সামনে রেখে। লক্ষ্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা থাকে। মহৎ কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বাস্তবায়নে যে সব দল কাজ করে, একদিন না একদিন দলটি সফল হবেই। ইতিহাস সেটাই বলে। একটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে নাগরিকদের এমন একটি সংগঠন যারা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকে। জনগণের সমষ্টিগত কল্যাণ কিংবা তাদের সমর্থকদের চাহিদা অনুযায়ী কিছু প্রস্তাবিত নীতি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐকমত্য পোষণ করে। আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও পরিচালনা পদ্ধতিতে কিছু মিল থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই ভিন্নতার মধ্যে কিছু তাৎপর্য থাকে। রাজনৈতিক দলের একটি মূল ভাবাদর্শ থাকে। তবে কিছু রাজনৈতিক দলের ভাবাদর্শই থাকে না। মূল ভাবাদর্শহীন রাজনৈতিক দল প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক দলই নয়। আবার কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠাকালীন ভাবাদর্শ থেকে দূরে সরে যায়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন থাকে। নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা অণুসারে জয়ী দল রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোই একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রণয়ন করে।

অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর জানা থাকা দরকার যে, রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি বা রাজগতি (রাজ্যের গতি) কিংবা রাজবুদ্ধি কী? এটা হচ্ছে দলীয় বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। যেমন সম্পদের সুষম বণ্টন হলো এমন একটি কর্মকাণ্ড। রাজনীতির একাডেমিক অধ্যয়ন হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাজই হচ্ছে রাজনীতি নিয়ে গবেষণা। রাজনীতি একটি বহুমুখী শব্দ। এটি আপসের ও অহিংস রাজনৈতিক সমাধান প্রসঙ্গে ইতিবাচক অর্থে অথবা সরকার বিষয়ক বিজ্ঞান বা কলা হিসেবে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। আবার এটি প্রায়ই নেতিবাচক অর্থও বহন করে। যেমন- উচ্ছেদবাদী উইনডেল ফিলিপস ঘোষণা দেন- ‘আমরা রাজনৈতিক চাল চালি না, দাস প্রথার বিরোধিতা নিয়ে হাসিতামাশা করা আমাদের স্বভাবে নেই।’ রাজনীতিকে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বিভিন্ন পরিসরে মৌলিকভাবে এ বিষয় নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা রয়েছে। মেযন এটি কীভাবে ব্যবহার করা উচিত, বিস্তৃতভাবে নাকি সীমিতভাবে, রাজকীয়ভাবে নাকি সাধারণভাবে এবং কোনটি এ ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী- সংঘাত নাকি সমবায়।

রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে আছে কারো নিজস্ব রাজনৈতিক অভিমত মানুষের মাঝে প্রচার করা, অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময়, আইন প্রণয়ন এবং বল প্রয়োগের চর্চা করা, যার মধ্যে আছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সামাজিক বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত পরিসরে রাজনীতি চর্চা করা হয়। ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থাসমূহের গোত্র ও গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আধুনিক স্থানীয় সরকার, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলোতে মানুষ প্রায়ই নিজস্ব মতবাদ তুলে ধরতে রাজনৈতিক দল গঠন করে থাকে। কোনো দলের সদস্যরা প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে সহবস্থানের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে এবং আইনের একই পরিবর্তন ও একই নেতার প্রতি সমর্থনে সহমত হয়। রাজনীতিকে উপলক্ষ করেই রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। সেই দলের যিনি নেতা হবেন, তার মধ্যে বিচক্ষণ্ণতা, দূরদর্শিতা, সাহস থাকতে হবে। আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেটা ছিল বলেই তিনি একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছেন। জনআকাঙ্ক্ষার জায়গায় যে রাজনীতির মশলা দিয়েছে, তার যথার্থতা প্রমাণ হয়েছে স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল সপরিবারে। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। শেখ হাসিনার শিশুপুত্র জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও বেঁচে যায় একই কারণে। শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া পরমাণু বিজ্ঞানী। স্কলারশিপে বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার সুবাদেই ১৯৭৫ সালের আগস্টে দেশে ছিলেন না। যদি থাকতেন তাহলে হয়তো সবারই ওই একই পরিণতি বহন করতে হতো। কিন্তু পরম সৃষ্টিকর্তা বাঙালি জাতিকে ও বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন সে উপলক্ষ্যেই তাদের বাঁচিয়ে রাখেন। ৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল। নেতাকর্মীরাও দিকভ্রান্ত। এমনি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা হিসেবে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করা হয় সর্বসম্মতিক্রমে। তিনি তখন ভারতে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ৬ বছর পর স্বদেশের মাটিতে পা রাখতেই জনতার উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলার সব প্রান্তে। ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনা দলকে পুনরুজ্জীবিত করে ক্ষমতার মসনদে বসাতে সক্ষম হন। নতুন ইতিহাসের জন্ম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দল স্বাধীনতা-পরবর্তী স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনার অসীম সাহস ও প্রজ্ঞা তথা রাজনৈতিক মেধার গুণে আওয়ামী লীগ বিশাল শক্তি অর্জনে সক্ষম হয়। সব ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত মোকাবিলা উপেক্ষা করে জনতার রায়ে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। মাঝখানে চক্রান্ত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ৭ বছর দখলে রেখেছিল বাংলাদেশকে। শেখ হাসিনা জেল-জুলুম সহ্য করে লক্ষ্য পথে থেকেছেন। তার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিন দফা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বর্ণাঢ্য জন্ম ইতিহাস কারো অজানা নয়। ইতিহাস সৃষ্টি করা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সব নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ থেকে চলমান ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশ, জাতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক- এই প্রত্যাশা জনতার।