ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আপনাদের ভাবনা

শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব পাক

ইসরাত জাহান
শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব পাক

মানুষ হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টা জ্ঞান, দক্ষতা, বিবেচনা বোধ দেননি, যা মানুষের মধ্যে দিয়েছেন। মানুষের মাঝে যে মেধা রয়েছে তাকে ব্যবহার করেই সুন্দর জীবনধারা তৈরি করে তারা। মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্যত্বের বোধ উপলব্ধি করতে পারে না, তা জাগিয়ে তুলতে হয়। তার একটি মাধ্যম লেখাপড়া। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের বিবেচনা বোধ জাগিয়ে তুলতে পারি, জ্ঞান অর্জন করে তা চলার পথে প্রয়োগ করতে পারি, জানতে পারি ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-ভুল, ভালো-খারাপ এর মাঝে তফাৎ কী।

লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য এসব হলেও বর্তমানে তা সার্টিফিকেট অর্জনের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়। ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পেতে হবে- এমন লক্ষ্য মাথায় রেখেই পড়ালেখা করে মানুষ, যা গৎবাঁধা পাঠ্যপুস্তক পড়া এবং সেটা পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ।

বইয়ের পাতায় কী বলছে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার তাগিদ বা তাড়না কোনোটাই আমাদের নেই। এই যেমন সদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা সকল পাপের মা। এগুলো পাঠ করে এবং পরীক্ষার খাতায় লিখে সার্টিফিকেট অর্জন ব্যতীত এর বাস্তব চর্চা কেউ করে না। কারণ তার কাছে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের চিন্তাই দৃঢ়। ফলে মানুষ হিসেবে গড়ার চেয়ে চাকরিওয়ালা হওয়াটাই তখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যার দরুন মানুষের মধ্যে দেখা দেয় মূল্যবোধের অভাব, সংকীর্ণ মানসিকতা, মনুষ্যত্বহীনতা।

এসব কারণে মানুষ খুব সহজে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে জড়িয়ে পড়ে সহিংসতা, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদিতে। একজন বাবাহারা শিশু ছোট থেকেই চিন্তা করে না কীভাবে সে তার ভেতরের প্রতিভা জাগ্রত করবে, কীভাবে সে প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে বরং সে ভাবনার জাল বুনতে থাকে কীভাবে সে টাকা উপার্জন করে পরিবারকে টিকিয়ে রাখবে।

তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের পড়াশোনা দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার মূল কারণ তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে পরিবারে অবদান রাখতে পারবে না, তাই ছেলেদের পড়াশোনায় জোর দেওয়া হয়, যার উদ্দেশ্য একমাত্র চাকরি। ১০০ জন শিক্ষার্থীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তোমাদের পড়ালেখা করার উদ্দেশ্য কী? তাদের মাঝে ৯৮ শতাংশ বলবে ভবিষ্যতে একটা ভালো চাকরি পাওয়া, বাকি ১ শতাংশ বলবে ‘শিক্ষিত’ শব্দের ট্যাগ লাগানোর জন্য, আর ১ শতাংশ বলবে জ্ঞান অর্জন করার জন্য। কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে চাকরি বা অর্থনৈতিক লাভ, যাকে ঘিরেই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া।

সূর্য পূর্বদিকে উদয় হয়- এটা যেমন সত্য আমাদের দেশে লেখাপড়া শুধু চাকরির জন্য করা হয়, এটাও তেমন সত্য। আমাদের বাবা-মা আমাদের পড়াশুনা করানোর ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থান নেয়। এটার কারণ ‘ভয়’। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র। তারা চায় না যে, তারা যেরকম অর্থ সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে, তাদের সন্তানরা সেটার মধ্য দিয়ে যাক এবং তার একমাত্র সমাধান হিসেবে তারা বেছে নেয় লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করা। একটা কমন ডায়ালগ আছে ‘লেখাপড়া করবি না তো কি রিকশা চালাবি?’

আমাদের দেশে জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করার আসল উদ্দেশ্যই চাকরি করা। কয়েক জন হয়তো প্রফেশনাল লেভেলে সিংগার, ক্রিকেটার তার পরেও পড়াশুনা করছে। তাদের হিসাব আলাদা, ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না।

আমি ৯৫ শতাংশ জনসংখ্যার কথা বলছি।

আমাদের লেখাপড়ার দরকার আছে, শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। তবে যেটা জীবিকা নির্বাহের জন্য লেখাপড়া করা হয় সেটা আসলে লেখাপড়া নয়। সেটাকে ট্রেনিং নেওয়া বা স্কিল অর্জন করা বলা যেতে পারে। যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেকচার ইত্যাদি।

মনুষ্যত্ব বিকাশ, মূল্যবোধ অর্জন এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জনের জন্য যে লেখাপড়া করা হয়, সেটাই আসল শিক্ষা। আমার মতে নৈতিক শিক্ষাই একমাত্র এবং ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড বিনির্মাণে প্রধান শিক্ষা। এই বিষয়ে লেখাপড়া করার প্রয়োজন আছে। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার রডের পরিবর্তে বাঁশ দেবে, ডাক্তার বিনা প্রয়োজনে হাজার হাজার টাকার টেস্ট করতে বলবে।

একটা দেশকে এগিয়ে নিতে, মানুষের মধ্যে ঐক্যজোট গড়তে, সুশীল সমাজ গড়তে, মানবসেবা করতে, পরার্থে জীবন দান করতে লেখাপড়ার মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, তবেই মানুষ আচরণে পশুত্বের পরিচয় দেবে না, মানুষে মানুষে সহিংসতা তৈরি হবে না, দেশের ক্ষতির স্বার্থে নিজেকে ভুল প্রয়োগ করবে না। এসব নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রয়োজন দেশের মানুষদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, যাতে করে তারা চাকরির তাড়নায় পড়ালেখা না করে, প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে, জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে পড়াশোনা করবে।

শিক্ষার্থী

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত