ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গণপরিবহণে নারীদের দুর্ভোগ ও তার প্রতিকার

জিহাদ হোসেন রাহাত
গণপরিবহণে নারীদের দুর্ভোগ ও তার প্রতিকার

গণপরিবহণকে নারীদের উপযোগী করতে অনেক লেখালেখি হলেও কার্যত এর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। দেশের ৫০.৪ শতাংশ যেখানে নারী, সেখানে গণপরিবহণ এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। জরিপে দেখা গেছে, প্রতিদিন ১০ লাখ নারী যাত্রী যাতায়াত করেন গণপরিবহণে। অথচ সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশানুযায়ী, নারীদের জন্য বরাদ্দ কেবল ৯টি আসন, যা চাহিদার তুলনায় অনেকটাই অপ্রতুল।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই অল্পসংখ্যক আসনও অনেকাংশে দখল করে নেয় পুরুষেরা।

এছাড়াও, নারীদের আসনে বিভিন্ন মালামাল ও বস্তা ওঠানোর ফলে সংরক্ষিত মহিলা আসনের উপযোগিতা নষ্ট হয়। এমনকি এই ঘটনা এখন প্রতিটি বাসে খুবই স্বাভাবিক যে, নারীদের সিটে পুরুষেরা বসে আছেন, আর নারীরা সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এক্ষেত্রে বাস চালক বা হেলপারের ভূমিকা থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীবিরোধী। অনেকবার সিট ছাড়ার কথা বলা হলেও তারা ভ্রুক্ষেপ তো করেই না, উল্টো ‘এত সমস্যা হলে রিকশাতে যান’ বলে হুমকিও শুনতে হয়।

কার্যকারণস্বরূপ, অধিকাংশ নারী তাই চুপ থাকাটাকেই পছন্দ করে। দিন দিন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাটি আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬ শতাংশ। রিকশা বা সিএনজিচালিত বাহন বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নারীরা বাসের ওপরই নির্ভশীল। কিন্তু অধিকাংশ নারী এসব বাসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। কারণ, অনেক সময় আসন পেলেও যাত্রীচাপ বেড়ে গেলে তাদেরকে অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় সুযোগসন্ধানী পুরুষ যাত্রীর দ্বারা।

ঢাকা আরবান নেটওয়ার্ক ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০ শতাংশ নারী যারা আগে গণপরিবহণ ব্যবহার করত তারা এখন যৌন হয়রানি, অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুল আসনের জন্য এসব যানবাহন এড়িয়ে চলেন। ব্র্যাকের গবেষণা মতে, গণপরিবহণে ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক বা শারীরিক হয়রানির শিকার হন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ময়মনসিংহে কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট রাতে চট্টগ্রামে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এরকম যৌন নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। এগুলো নিঃসন্দেহে এমন একটি সমাজকে নির্দেশ করে, যেখানে নারী অধিকার চরমভাবে ভূলণ্ঠিত।

ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ৮১ শতাংশ নারীর বক্তব্য, তারা চুপ থাকেন এবং ৭৯ শতাংশ বলেছেন, তারা আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান।

সরকারিভাবে কিছ ুসংখ্যক বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, তেরটি শহরে ১৬টি একতালা ও দোতলা মহিলা বাস সার্ভিস, বাস চালক ও হেলপারের নামের তালিকাকরণ যদিও প্রশংসার দাবি রাখে; কিন্তু ধারাবাহিকতা ও তদারকির অভাবে নারীদের জন্য তা ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১৮ সালে রাজধানীতে দোলনচাঁপা মহিলা বাস সার্ভিস চালু হয়, যার মধ্যে এখন কেবল একটি সচল রয়েছে। অন্যদিকে, বিআরটিসির ২২টি বাসের কয়েকটি চালু আছে।

২০১৯ সালে দেশে ৫২টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি যেসব প্রস্তাবনা দেয়, তার বাস্তব প্রয়োগ দৃশ্যমান নয়। যতদিন আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হবে, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা এক প্রকার অসম্ভব। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। মহিলা বাস সার্ভিস আরও বেশি সংখ্যায় চালু করা এখন সময়ের দাবি। নারী আসন নিশ্চিতকরণে স্টপেজগুলোতে সার্জেন্টদের তদারকির প্রয়োজন এবং নিয়ম লঙ্ঘনে জরিমানার ব্যবস্থা চালক ও ভাড়া আদায়কারীকে বাধ্য করবে মহিলা আসন সংরক্ষণ করতে। সিটিং সার্ভিস চালু করাটাও আবশ্যক। এতে করে ভিড়ের জন্য বিড়ম্বনার শিকার হতে হবে না নারীদের। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর এক্ষেত্রে পুরুষদের আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। নারী হয়রানির ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করার মানসিকতা তৈরি করা জরুরি। প্রতিটি বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার দ্বারা অপরাধী চিহ্নিতকরণ করার পাশাপাশি অপরাধের পরিমাণ কমিয়ে আনাও সম্ভব। সর্বোপরি একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন গণপরিবহণকে নারীবান্ধব করে গড়ে তুলতে।

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত