কালের কড়চা

মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফর ব্লিঙ্কেনের চীন ভ্রমণ

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২০২৩ সালকে চ্যালেঞ্জিং বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার ছক কষে রেখেছেন বিশ্ব নেতারা। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব সভ্যতাকে অনেকটাই সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। কেন এই যুদ্ধ? এই প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মুখে। যুদ্ধের মৌলিক কারণ তো সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। তারপরও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ। যারা যুদ্ধের কথা কল্পনাও করে না। আবার এই সাধারণ মানুষই কখনো কখনো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা তথা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সে রকম ঘটনা কিনা তা অনেকটাই অজানা। যুদ্ধটা রাশিয়া-ইউক্রেন হলেও এর প্রভাব পড়েছে সারা দুনিয়ায়। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। ভোগ্য পণ্যের মূল্য এতটা বেড়েছে যে, সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে এসেছে। সে জন্যই এ যুদ্ধটা বন্ধ হওয়া দরকার। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতিও অনেকটা বদলে গেছে। শত্রু-মিত্র চেনা দায় হয়ে পড়েছে। কূটনীতির অংকেও ফল মিলাতে পারছেন না কূটনীতিকরা। এশিয়ার শক্তিশালী চীন ও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। দেশ দুটোকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র নানা পন্থা অবলম্বন করছে। গঠন করে চলেছে বিভিন্ন সংগঠন। কোয়াড তার একটি উদাহরণ। কৌশলগত কারণে কখনো শত্রু ভাবাপন্নের সঙ্গেও জোট গঠন করতে হচ্ছে। এটাই রাজনীতি। ভূরাজনীতিতে নতুন খেলোয়াড় হিসেবে জাপানের আবির্ভাব ঘটেছে। জাপান এখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ শরিকে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। ঢেউ খেলছে, কখন কীভাবে কোন দিকে এই ঢেউ আঁচড়ে পড়বে তা বলা মুশকিল। এমনি পরিস্থিতিতে বৃহৎ গণতান্ত্রিক ও বৈদিক দর্শনধারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফর করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন ও ফার্স্টলেডি ড. জিল বাইডেনের আমন্ত্রণে মোদিজির যুক্তরাষ্ট্র সফর বিশ্বরাজনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষজ্ঞ। নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ৯ বছরে অন্তত : পাঁচবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। এক সময় নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা স্যাংশন দিয়েছিল। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১৪ সালে ভারতের জনতার রায়ে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন দেশটির। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে উঠিয়ে সসম্মানে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছে মোদিকে। দিয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্মান।

যাইহাক, এবারের সফর আগের সফরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণও বটে। বাইডেন প্রশাসন এ সময় একটু বেকায়দায় পড়ে রয়েছে নানা কারণে। ভূরাজনীতির খেলায় ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়েছে কিনা; সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনীতি সাজাতে বাংলাদেশকে তার লাগবেই। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ একটি চমৎকার ফুল হিসেবে বিবেচিত। তাই এই ফুলটিকে কাজে লাগাতে গিয়ে যাতে বাধার সম্মুখীন না হয়, সেরকম দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কেন্দ্রিক নতুন ভিসানীতি প্রণয়ন করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসানীতি প্রণয়ন কীসের ইংগিত? যুক্তরাষ্ট্র ইনিয়ে বিনিয়ে তার আজ্ঞাবহ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় বাংলাদেশে। যাতে সেন্টমার্টিনে নৌ-ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সাহসী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সার্বভৌমত্ব ও বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্নে কখনো কারো সঙ্গে আপোষ করবেন না তা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। আমেরিকাকে পরোয়া করছেন না। অনেকেই মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান হুংকারে ভীত হয়ে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে জো-বাইডেনকে কিছু বলার মেসেজ দিয়েছে। কিন্তু বিষয়ি আসলে তা নয়। বরঞ্চ বাইডেন প্রশাসনই বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে ঝুঁকে না পড়ে, সে জন্য কৌশলি ভূমিকার অংশ হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ যদি চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বা চীনের ফাঁদে পা দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েরই ক্ষতি। এমন ভাবনা থেকেই বাইডেন মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সফরের। যুক্তরাষ্ট্র সফরে মোদি প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। বিশ্লেষকরা এই সফরকে ঐতিহাসিক বলছেন। তিনি স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে সফর করেছেন। সফরকালে মার্কিন কংগ্রেসের উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণে দিয়েছেন। আরেকটি বিষয় লক্ষনীয় যে, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দল মিলে মোদিকে যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দানের আমন্ত্রণ পত্রটি পাঠিয়েছেন। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় যে, মোদি বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের নেতার চেয়ে মার্কিন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। এ সফর গণতান্ত্রিক বৃহৎ দুই দেশের ইতিহাসে এক নবতর অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বাইডেন-মোদি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকসহ বিভিন্ন বৈঠক হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভোজসভা ও বাইডেনের ব্যক্তিগত দেয়া ভোজ সভায়ও অংশ নিয়েছেন মোদি। সফরে কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর এগুলো গতানুগতিক। মোদির এই সফরে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির গতিপথ নতুনভাবে বিকশিত হবে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে একাধিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি সুযোগের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। উভয় দেশই তাদের মূল্যবোধ ও স্বার্থের ভিত্তিতে কয়েক বছর ধরে ঘনিষ্ট কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তবে এটাও ঠিক কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু, স্থায়ী শত্রু বলে কোনো কথা নেই কৌশলগত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং সময়ের প্রয়োজনে বন্ধুও কখনো শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ বিপ্লবে অংশীদার ছিল। ১৯৬৫, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ভারত সম্পর্কের খাদ তৈরি হয়েছিল। সেটা এখন অতীত।

এদিকে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ গলাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন চীন সফর করেছেন। পরস্পরকে ভুল মূল্যায়ন এড়াতেই এই সফর, এমন মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। একে অপরের সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করার জন্যই সফর। কিন্তু কতটা কী হয়েছে? আদৌ কী সফর সফল হয়েছে? আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে তীব্র কূটনৈতিক প্রতিযোগিতা অপরিহার্য। টেকসই কূটনীতির টেকসই উন্নয়নের ভীত রচনা করতে পারে। কিন্তু এ কূটনীতি প্রতিযোগিতা যদি সংঘাতের দিকে গড়ায় তবে তা হবে বিশ্ব সভ্যতার জন্যে হুমকি। বিশ্বের মানবজাতি চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তা কখনো প্রত্যাশা করে না। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছিল। প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম অতিসম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীন সফর করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কেন্দ্রিক দুই দেশের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধও অনেকটা দৃশ্যমান। যুদ্ধের উত্তেজনা হ্রাস করার লক্ষ্য নিয়ে ব্লিঙ্কেন চীন সফর করেছিলেন। কিন্তু চীনা প্রেসিডেন্ট শি-জিং পিং এর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাক্ষাতের একদিন পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্টকে স্বৈরশাসকের সঙ্গে তুলনা করে বিবৃতি দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে চীন। জো-বাইডেনের এমন বক্তব্যকে অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছেন চীন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাওনিং বলেন, ‘বাইডেনের মন্তব্য সম্পূর্ণ সত্যের বিরুদ্ধে ও গুরুতর কূটনৈতিক প্রটোকল ও চীনের রাজনৈতিক মর্যাদাকে লঙ্ঘন করেছে।’ বিশেষজ্ঞরা মনে করছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল তা প্রশমনে এই সফর খুবই কার্যকরি হবে; কিন্তু তা হয়নি। বাইডেনের মন্তব্যে আগুনে ঘি ঢালার মতো। মোদ্দা কথা, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী। আধিপত্যবাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে কখনো স্থায়ী মতৈক্য হয় না। ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দিয়ে আসছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরের কোনো তাৎপর্যই বহন করে না। মূলত : চীন যাতে বাংলাদেশকে করায়ত্ত্ব করতে না পারে, সেটি ছিল মূল লক্ষ্য। শেখ হাসিনার অবস্থান খুবই পরিষ্কার। দেশ ও জাতির স্বার্থে যা যা করা দরকার শেখ হাসিনা সেটিই করছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ এখন আলোচনার বিষয়ে গুরুত্বর্পূণ দেশ। এটা কম কী?