আন্তর্জাতিক মাদক পরিহার দিবস

মাদকের ভয়াল থাবা, ধ্বংসের পথে যুবসমাজ

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি, সর্বগ্রাসী মরণনেশা। এ নেশার কারণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত দেশের লাখ লাখ মানুষ বিশেষ করে যুবসমাজ। মাদকের নীল দংশনে তরুণ সমাজ আজ বিপথগামী, বিপন্ন। এর বিষবাষ্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। মাদকের বিষাক্ত ছোবল গ্রাস করে চলেছে নতুন প্রজন্মকে। ফলশ্রুতিতে এর বিষাক্ত কামড়ে অকালে ঝরে পড়ছে বহু তাজাপ্রাণ। শূন্য হচ্ছে অনেক মায়ের বুক। সে সন্তান হারা মা-বাবার আহাজারিতে দিন দিন ভারি হচ্ছে বাতাস। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোতে এখন শুধু শোকের মাতুম। কারা সৃষ্টি করছে এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতি? কারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এ ভয়ানক আতঙ্ক। কারা কেড়ে নিচ্ছে মায়ের বুক থেকে তার প্রিয় সন্তানকে, দায়ী কারা? আজ আমরা এমনই এক বৈরী পরিবেশে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি।

জর্জ বানার্ডশকে আমরা জানি। তিনি বলেছিলেন, ‘মধ্যযুগের লোকরা তাদের রুচিসম্মত উৎকৃষ্ট দ্রব্য উৎপন্ন করত বলেই যে বর্তমানের তুলনায় সহজ সুন্দর জীবনযাপন করত তা নয়। তার প্রধান কারণ তারা মাদকাসক্ত ছিল না। ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতীদের মাদকাসক্ত ভাব দেখে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোস্তাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক হেরিংটন অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুস্থ রাখতে হলে ছেলেমেয়েরা যাতে মাদকাসক্ত না হয়, সেদিকে প্রতিটি নাগরিকের সচেতন হওয়া উচিত। এ বার্তা বিশ্বের প্রতিটি দেশের সচেতন নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি মিডিয়ার প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

মানবধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থার দৃষ্টিতে নেশা জাতীয় দ্রব্য উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও সেবন গর্হিত কাজ হিসেবে পরিগণিত হলেও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে এসব উৎপাদন, বিতরণ ও পাচারের মাধ্যমে আয় করছে প্রভূত অর্থ, গড়ে তুলছে অবৈধ সম্পদ। অথচ এর খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে।

আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে বিচরণ করছে সর্বনাশা মাদক। ঘুণে পোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে মানব অস্থিমজ্জা। অজগরের ন্যায় হামুখে খাওয়ার উপক্রম করছে গোটা মানব জাতিকে। এ ভয়ানক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব। অভিভাবকরা আতঙ্কিত, উৎকণ্ঠিত। তারা শংকিত কখন মাদকের স্রোতে দিক হারিয়ে নেশার জালে আটকা পড়ে যায়, তাদের প্রিয় সন্তান। কখন ছোবল মেরে নেশাগ্রস্ত করে পাঠিয়ে দেয় মরণকূপে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষার জন্য মা-বাবার সঙ্গে পুরো জাতি আজ শঙ্কিত, আতঙ্কিত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে মাদক কি? ফেনসিডিল, হিরোইন, কোকেন, সিডাকসিন, ইনোকট্রিন, মরফিন, টেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনল, মেথাডন, বিয়ার, কেনা বিসরেসিন, এ্যাবসলিউট অ্যালকোহল, ভেষজ কেনাবিস, গাঁজা, দেশি-বিদেশি মদ প্রভৃতি। তবে বর্তমানে ভয়াবহভাবে ফেনসিডিল, ভায়াগ্রা আর ইয়াবার ব্যবহার হচ্ছে সর্বত্র। এর পরিণাম যে কি হবে তা নিয়ে ভাবলে শরীরে শিহরণ জাগে।

মাদক ব্যবহারে শরীরে স্বল্পমেয়াদি প্রতিক্রিয়া

১. মাদক রক্তচাপ কমায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা হ্রাস করে। ২. মাদক সেবনে ক্ষুধা ও যৌন অনুভূতি দ্রুত হ্রাস পায়। ৩. মতি বিভ্রম ঘটে এবং সন্ত্রস্ত ভাব দেখা যায়। ৪. শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। ৫. মাদকসেবী ক্রমে নিস্তেজ এবং অবসন্ন হয়ে যায়। ৬. হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলে রক্তচাপও বৃদ্ধি পায়। ৭. চলাফেরায় অসংলগ্নতা ধরা পড়ে। ৮. স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগের ক্ষমতা সাময়িক হ্রাস পায়। তাই যে কোনো মুহূর্তে জীবন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ৮. চোখ লালচে হয় এবং মুখ শুকিয়ে যায়। ৯. উগ্র মেজাজ, নিদ্র্র্রাহীনতা ও রাগান্বিত ভাব দেখা যায়। ১০. চামড়ায় ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব এবং নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১১. অধিক মাত্রায় মাদকসেবী মাতালের মতো আচরণ করে এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।

মাদক ব্যবহারে শরীরে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া

১. স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। ২. এছাড়া মস্তিষ্কে কোষের ক্ষয় প্রাপ্তি ঘটতে পারে। ৩. স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। ৪. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান লোপ পায়। ৫. জীবনের সববিষয় নিরাসক্ত হয়ে পড়ে। ৬. কোনো কোনো মাদকদ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ৭. মাদকাসক্ত মেয়েদের গর্ভের সন্তানের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং সন্তানও মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মাদক ব্যবহারে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি

শ্বাস, প্রণালিতে ক্ষতি : খুসখুসে কাশি থেকে যক্ষা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, ক্যান্সার, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীন হওয়া। ১. চোখের ক্ষতি : চোখের মনি সঙ্কুচিত হওয়া, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া। ২. লিভারের ক্ষতি : জন্ডিস, হেপাটাইটিস, সিরোসিস ও ক্যান্সার হতে পারে। ৩. কিডনীর ক্ষতি : কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়া, পরিশেষে কিডনি অকার্যকর হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি। ৪. হৃদযন্ত্র ও রক্ত প্রণালিতে ক্ষতি : হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্র বড় হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া। রক্তকণিকার সংখ্যায় পরিবর্তন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি। ৫. খাদ্য প্রণালীতে ক্ষতি : রুচি কমে যাওয়া, হজমশক্তি হ্রাস পাওয়া, আলসার, এসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্যান্সার ইত্যাদি। ৬. ত্বকের ক্ষতি : ভিটামিন ও পুষ্টির অভাবে ত্বক হয়ে উঠে খসখসে শুষ্ক। চুলকানি, ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, ফোঁড়া, ঘা ইত্যাদি। ৭. যৌন ক্ষমতা ও প্রজননের ক্ষতি : যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, যৌন স্পৃহা কমে যাওয়া, বিকৃত শুক্রানু থেকে বিকৃত সন্তানের জন্ম, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা। সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে এ প্রভাব আরও মারাত্মক। গর্ভের সন্তান বিকৃত হয়ে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা, জন্মকালীন শিশুর স্বল্প ওজন, জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হওয়া।

মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্র এবং মানসিক ক্ষতি : নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রলাপ বকা, আত্মহত্যার প্রবণতা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অসচেতনতা, মাথা ঘুরানো, চিন্তাশক্তি লোপ পাওয়া, অমনোযোগিতা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অস্থিরতা ও অধৈর্য অবস্থা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, উদ্বেগ, ভয় পাওয়া, বিষণ্ণতা ইত্যাদি মানসিক রোগ দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রে।

মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার উপায় : মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার স্বাভাবিক লক্ষণগুলো হলো- ১. চোখে সাধারণ আকৃতির চেয়ে বড় করে তাকানো। ২. হঠাৎ স্বাস্থ্যহানী বা আকস্মিক স্বাস্থ্যবান হয়ে যাওয়া। ৩. চোখ ও মুখ ফোলা এবং চোখ লালচে হওয়া। ৪. সামান্য বিষয়ে অতিরিক্ত রেগে যাওয়া। ৫. অধিক রাত করে ঘুমানো এবং বিলম্বে ঘুম থেকে উঠা। ৬. একাকী অন্ধকার নির্জন রুমে সময় কাটানো। ৭. উদাসী-উদাসী ভাব এবং সবকিছুতে ভুল করা। ৮. নিকটাত্মীয় এবং পরিবার পরিজনদের সাহচর্য এড়িয়ে চলা। ৯. সব বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, হীনমন্যতায় ভোগা। বিষণ্ণ খেয়ালে ভাবনার গভীর অন্তরালে কিছু খোঁজা। ১০. বেশি বেশি টাকা ব্যয় করা এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা। ১১. কখনো খাদ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আবার কখনো হ্রাস পাওয়া। ১২. নিজের শরীর স্বাস্থ্য ও পোশাকের প্রতি খেয়ালহীনতা ইত্যাদি সাধারণ কারণ, যা সহজেই ধরা পড়তে পারে।

পারিবারিক কর্তব্য : পারিবারিকভাবে মাদক বা ড্রাগসেবীদের চিহ্নিত করতে পারলে, তাদের উচিৎ কাজ হলো- ১. মাদকে আসক্তির মূল কারণ খুঁজে বের করা। ২. প্রেমঘটিত কোনো কারণ হলে এর সুস্থ সুন্দর সমাধান দেওয়া। ৩. মানসিক পারিবারিক চাপ প্রয়োগ না করে তাকে ভালোবাসা ও স্নেহের বন্ধনে আরও নৈকট্যে নিয়ে আসা। পরিবারের কেউ অন্তত তার খুব কাছাকাছি হওয়া এবং বন্ধুত্বের স¤পর্কে আবদ্ধ হওয়া। ৪. সর্বোপরি তাকে বুঝিয়ে মাদকসেবন থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করা। ৫. মাদকাসক্তদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ না দেয়া।

সুতরাং, এ মাদক বা ড্রাগের কালো বিষাক্ত ভয়াবহ ছোবল থেকে নিজে বাঁচুন, আগামী প্রজন্মকে বাঁচান। পারিবারিক, ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ রক্ষা করুন। আসুন, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আমরা পরস্পর পরস্পরের সহযোগী বন্ধু হই। শুধু আইন করলেই হবে না, বিপ্লব করলেই হবে না, সংস্কারমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসাধারণের বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে মাদকবিরোধী চেতনাকে, জোরদার করতে হবে এ আন্দোলনকে। আমরা সেদিনই মাদকবিরোধী আন্দোলনে সফল হবো- যেদিন সবাই মিলে সুস্থ জীবনবোধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে সক্ষম হবো। গড়ে তুলতে পারব সুস্থ, সুন্দর, সবল ও সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা।

পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা বাকারায় বলা হয়েছে- হে নবী! আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আপনি বলে দিন- এ দুটোর ব্যবহারই মহাপাপ।

সুষ্ঠুভাবে বাঁচার স্বার্থে আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুস্থ, সুন্দর পৃথিবী গড়ার প্রত্যাশায় বিশ্ব বরণ্য গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের সুরে আমরাও বলি- Hail the world and make it better place to live in অর্থাৎ রিক্তশ্রী পৃথিবীতে শুভবুদ্ধির জয় হোক।