জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য : আশীর্বাদ না অভিশাপ

নুসরাত জাহান পন্নি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বছর দুয়েক আগে ফিলিপাইনে ৫০ জনের মতো মানুষ একটি বিশাল ধানক্ষেতের বেরিকেড ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সব ধান উপড়ে ফেলে। তারা ক্ষুধার্ত ছিল বলে এমন করেছে, বিষয়টি মোটেও এরকম নয়। বরং তাদের এটা করার কারণ ছিল ঠিক উল্টো। কেননা, ওই ক্ষেত ছিল মূলত জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য গোল্ডেন রাইসের ক্ষেত। এটা এমন শস্য, যেটা পর্যাপ্ত ভিটামিন সরবরাহ করার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে অন্ধত্ব সারিয়ে তুলতে পারে। যদি এ জেনেটিক্যালি মডিফাইড গোল্ডেন রাইস এত উপকারী হয়, তাহলে কেন এই লোকগুলো এতটাই রেগে গেল যে সব শস্য তারা ধ্বংস করে ফেলল?

যেসব খাদ্যদ্রব্য বা গাছের আমরা নিজেদের প্রয়োজনে জিনগত পরিবর্তন করি, সেগুলোকেই বলে জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফুড (GM Food)। যদিও জেনেটিক পরিবর্তনের প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে; কিন্তু বর্তমান জেনেটিক্যালি মডিফিকেশনের ধরন কিছুটা ভিন্ন। যেমন আগে যদি কৃষক তার গাছের বরইকে আরো মিষ্টি করতে চাইত, তাহলে সে মিষ্টি বরই আর কলম লাগাত এই আশায় পরের বছরের বরই হয়তো মিষ্টি হবে। এটা ছিল পুরোটাই ভাগ্যের ব্যাপার আর তার সঙ্গে লাগত কয়েক বছরের অধ্যবসায়। অন্যদিকে জিনগত পরিবর্তন অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট। এটি কোনো একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীর একটি নির্দিষ্ট জিনকে অন্য শস্যে স্থানান্তর করে। এ পদ্ধতিতে আপনি জানেন যে, পরবর্তী সময়ে শস্যে কি ধরনের পরিবর্তন আসবে। এই জিনগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এই প্রক্রিয়া নিয়ে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। যার কারণে প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান জিনগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অনেক বেশি সহজ ও সুনির্দিষ্ট। তাহলে জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য নিয়ে কেন এত বিতর্ক?

২০১৫ সালের একটি জরিপে দেখা যায় আমেরিকাতেই শুধু ৩৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য নিরাপদ। অথচ আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সাইন্স-এর ৮৮ শতাংশ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে জিনেটিকালি মডিফাইড খাদ্য নিরাপদ। তাহলে সংখ্যাগুলোর পার্থক্য এত বেশি কেন? অনেকের মতে এর কারণ হলো ভুল তথ্যের প্রচার এবং রাজনীতিকরণ।

যারা জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের বিপক্ষে কথা বলে তাদের যুক্তি হলো যে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যে খাদ্যগুণ বিঘ্নিত হয়। যেটা খেলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাদের মতে, খাদ্যে টক্সিন-এর পরিমাণ বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে বাড়ে এলার্জির মাত্রাও।

অন্যদিকে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের পক্ষের লোকেদের দাবি হলো জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলা করতে পারে, জলবায়ু পরিবর্তনকে কমিয়ে আনতে পারে, টেকসই বন্যা-খরা সহিষ্ণু শস্য উৎপাদন করতে পারে, শস্যের ফলন বৃদ্ধি করতে পারে।

কিন্তু এদের সবার সব কথা সঠিক নয়। প্রথমত, জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। ৬৯৮টি গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে পুষ্টির দিক দিয়ে জেনেটিকালি মডিফাইড খাদ্য এবং প্রচলিত খাদ্যের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আবার যদিও জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য অধিক টেকসই এবং বন্যা-খরা সহিষ্ণু শস্য উৎপাদন করে এর মানে এই না যে, এটা বৈশ্বিক ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে অথবা জলবায়ু পরিবর্তনকে পুরোপুরি কমিয়ে আনতে পারে। বাজারে এখনো গুটি কয়েক খরাসহিষ্ণু ফসল আছে, যেটা প্রচলিত শস্য থেকে অল্প কিছুটা বেশি উৎপাদনশীল। এছাড়া প্রায় ৯০ শতাংশ জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য ব্যবহৃত হয় ইথানল তৈরি, গবাদি পশুর খাবার অথবা উচ্চ শর্করাযুক্ত কর্ণ সিরাপের মূল উপাদান হিসেবে। তাই এই ধরনের বেশিরভাগ শস্যই খাদ্য সংকটের সমাধান দিচ্ছে না। উপরন্তু, তারা বাজারে কর্ণ সিরাপ-এর মতো অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সংযুক্ত করছে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, যেহেতু আমরা প্রতিনিয়ত উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ অপচয় করি সেহেতু বৈশ্বিক খাদ্য সংকট বেশি ও উন্নত খাবার দিয়ে কমবে না। এর জন্য প্রয়োজন খাদ্যের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং দক্ষতার সঙ্গে খাদ্যের রসদ পরিচালনা করা।

যাইহোক, ফসলের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে জেনেটিক্যালি মডিফাইড শস্য অসাধারণ। যেমন ১৯৫০ থেকে ১৯৯০-এর দিকে পেঁপের এক ধরনের জাতের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল একটি ভাইরাসের কারণে। ফলশ্রুতিতে, ক্ষেত নষ্ট হচ্ছিল এবং চাষিরা পেঁপে চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে এই ভাইরাস প্রতিরোধী জেনেটিক্যালি মডিফাইড পেঁপে বাজারে আসার পর তা ব্যাপক সাড়া ফেলে। এক দশকের মধ্যেই এটা প্রচলিত পেঁপের বাজার দখল করে ফেলে আর উৎপাদন ও বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫ শতাংশ।

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য এত নিরাপদ এবং উপকারী হলে সমস্যাটা আসলে কি? জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের বিতর্কের পেছনে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য দায়ী নয়। মূলত দায়ী হলো এর পেছনে থাকা ইন্ডাস্ট্রিয়াল চাষাবাদ পদ্ধতি। যেহেতু এগুলো অনেক বেশি টেকসই সেহেতু কেমিক্যাল সার-এর তেমন কোনো ক্ষতি করে না। তাই জেনেটিক্যালি মডিফাইড ক্ষেতে কেমিক্যাল সার ব্যবহারের মাত্রা জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে। ফলে অতিরিক্ত কেমিক্যাল স্প্রে করার কারণে অনেক ডেডজোন তৈরি হচ্ছে, নদী বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। আরেকটা গুরুতর বিষয় হলো এসব শস্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরো বাজারকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে করে শস্যের দাম অনেক বেড়ে যায় আবার কৃষকরা পরবর্তী সময়ে বছরের জন্য শস্যদানা সংরক্ষণও করে রাখতে পারে না।

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের কারণে হাতেগোনা কিছু কোম্পানির হাতে আমাদের খাদ্য সরবরাহের উপর ব্যাপক ক্ষমতা চলে যায়। আবার এসব শস্যক্ষেতের আগাছা এবং ঘাস দমনে উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী সময়ে, বাজারে শুধু দেখতে হৃষ্টপুষ্ট খাবার বেশি গুরুত্ব পায়, মোটামুটি দেখতে পুষ্টিকর খাদ্যের উপরে।

দিন শেষে জেনেটিক্যালি মডিফিকেশন শুধু একটি প্রযুক্তি, কোনো ফুড সিস্টেম নয়। তাই অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই জেনেটিক্যালি মডিফিকেশনকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ সময়ই এই প্রযুক্তি ভুল হাতে চলে যায়। যেমন বর্তমানে মাত্র চারটি কোম্পানি গোটা বীজের বাজারকে দখল করে আছে। আর এটা যে খাদ্য উৎপাদনে কি ধরনের প্রভাব ফেলে তা বলাই বাহুল্য।

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাতে বেশ কাজে দিতে পারে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। এটা কখনোই এক চুটকিতে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে পারে না। আমাদের এর জন্য আরো গবেষণা এবং উদ্ভাবন করতে হবে।

তবে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক সমস্যারই সমাধান আমাদের কাছে আছে। যেমন কৃষি বনায়ন, সমন্বিত আগাছা এবং কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা, পলিকালচারাল সিস্টেম ইত্যাদি।

এগুলো শুধু টেকসই নয়, এতে ফলনও বেশি ঘটে এবং বাতাস থেকে কার্বনডাই-অক্সাইড শুষে নিতে এগুলো অনেক বেশি পারদর্শী।

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যকে আমাদের খাদ্যব্যবস্থার অসংখ্য বৈচিত্র্যের মধ্যে শুধু একটি সংযোগ হিসেবেই দেখা উচিত। যদিও এর বেশ কিছু নেতিবাচক দিক আছে; কিন্তু এটা শস্যকে আরো উন্নত, পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এবং সুস্বাদু করতে পারে। দক্ষতা এবং নৈতিকতার সঙ্গে এ প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ বয়ে নিয়ে আসবে।