কালের কড়চা

জোর যার, মুল্লুক তার

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]

প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘জোর যার, মুল্লুক তার’ এটি পুরোনো প্রবাদ বাক্য। এর অর্থ হচ্ছে শক্তিমানরাই সবকিছুর অধিকারী। আইনকানুন বা নিয়মনীতির কোনো প্রয়োজন নেই, শক্তি আছে তো সবকিছু আছে। এই প্রবাদ বাক্যটি আধুনিক সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। কেউ জোর করে জমি দখল, বাড়ি দখল, ভোট কেন্দ্র দখল, টাকা আত্মসাৎ, অনেক ক্ষেত্রে নারী দখলের প্রাসঙ্গিকতায় উপরোক্ত প্রবাদ বাক্যটিকে উত্থাপন করা হয়ে থাকে। আসলে জোর যার মুল্লুক তার কথাটি সৃষ্টির গোড়া থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা যে সম্পদের ভাগিদার কিংবা অর্থসম্পদের মালিক, এসবই কিন্তু এক অর্থে জোর যার মুল্লুক তার থিউরিতে অর্জিত। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী নামক গ্রহটি ৪৩৫ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে মতভেদ বা বিতর্ক আছে। তারপর এই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব মিলে। প্রাণের অস্তিত্ব থেকে বিভিন্ন প্রাণীসহ মানুষের উদ্ভব ঘটে। কালক্রমে সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং মানুষের আচারি বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব হয়। মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ নিয়েও মতভেদ আছে। ধর্মের উদ্ভবের পর মানুষের সৃষ্টি বা বিকাশ নিয়ে নানা মত প্রচলিত। একেক ধর্মের একেক রকম মতবাদ রয়েছে। বিভিন্ন মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মীয় সম্প্রদায় গোষ্ঠী। মূলত: তখন থেকেই ‘জোর যার মুল্লুক তার, কথাটি প্রযোজ্য। মানব জাতি জীবশ্রেষ্ঠ। এই মানব জাতির কেউ কোনো সম্পদ নিয়ে আসেনি। যা কিছু অর্জন, দান, পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। রাষ্ট্র যখন গঠিত হয়, তখন একটি উদ্দেশ্য কাজ করেছিল, সেটি হচ্ছে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা; বা সুশৃঙ্খল করা; কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থাও যে জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সিটি কী অস্বীকার করা যাবে? রাষ্ট্রের সংজ্ঞা- রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে নিরূপণ করেছেন। যেমন ম্যাক্স ওয়েবারের প্রভাব বিস্তারি সংজ্ঞানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইনানুগ বল প্রয়োগের সব মাধ্যমের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাদের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী, নাগরিক সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে মত ভিন্নতার কারণে তাত্ত্বিক মহলে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই আলোচনাকে কেন্দ্র করে কীভাবে একটি সার্থক রাষ্ট্্র, এর অভ্যুদয়কে সমর্থন করা যেতে পারে। ব্যাপকার্থে সরকার বা প্রাচীন এবং আধুনিক সব অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠানকেই রাষ্ট্র প্রত্যয়টির অংশ হিসেবে ধরা হয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যাদের সমন্বিত পদ্ধতির অংশ হয়ে উঠাটা প্রথমে স্পষ্টভাবে দেখা যায় ১৫ শতক নাগাদ। আর ঠিক সেই সময়ই রাষ্ট্র প্রত্যয়টি প্রায়ই নির্দিষ্ট করে শুধু আধুনিক রাজনৈতিক কাঠামোকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর গোড়া পত্তনের ভেতর দিয়ে যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হয়, তখন এই জোর যার মুল্লুক তার নীতিকেই গ্রহণ করেছিল। দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা ছিল প্রবল। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের রাজা পার্শ্ববর্তী অন্য রাজার ভূখণ্ড দখলে তলোয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হত। যিনি পরাজিত হতেন তিনি রাজ্য হারাতেন। দখলদারিত্বের ভিত্তিতে বংশানুক্রমিকভাবে রাজপ্রথা এখনও বিলুপ্ত হয়নি। ব্রিটিশ রাজ এখনও বহাল আছে, তেমনি সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্যে বাদশাহ, নবাব প্রথা বিদ্যমান। এই উপমহাদেশ মানে ভারতবর্ষের কথা যদি ধরি, তাহলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন বংশ বিভিন্ন মুল্লুক শাসন করেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল পরগণাভিত্তিক। একেক পরগণার একে শাসকের আবির্ভাব ঘটেছে গায়ের জোরে। যে যেভাবে ভূমি দখল করে মালিক ঘোষণা করেছে, সেভাবেই সে মালিক হয়েছে। এভাবেই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। পাল বংশ, সেন বংশ, গুপ্ত বংশ, নবাব জাদা এরা সবাইতো দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানা লাভ করেছিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব ছিলেন। ইংরেজরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে এসে দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় ভারতবর্ষ দখল করে নেয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। কীভাবে পরাজিত হন সে ইতিহাস সবারই জানা। তারপর প্রায় ২০০ বছর ইংরেজরা শাসন করেছে এই দেশ।

জোর দখল করে শাসন করাটা তো কোনো অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়নি। ব্রিটিশদের প্রণীত আইন দ্বারাই আজও আমরা চালিত হচ্ছি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা আলবর্দী খাঁর দৌহিত্র ছিলেন। আলীবর্দী খাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তার ছিল তিন কন্যা, তিন কন্যাকেই নিজের বড় ভাই হাজি আহমদ-এর তিন পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন। আলীবর্দীর ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের সন্তান মীর্যা মুহাম্মদ ওরফে সিরাজউদ্দৌলা। ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংঘাত আলীবর্দীর পরিবারেও ছিল। আলীবর্দী খাঁ আরব বংশোদ্ভূত। তার পূর্ব পুরুষরা পেটের দায়ে এই উপমহাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে জোরদখলে বাংলার বিহার উরিষ্যার সিপাহশালার হয়ে উঠেন। শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পর ইংরেজরা জোর করেই ক্ষমতা দখল করে এরপর দেশ ভাগ হয়। দেশ ভাগের পরও জোর যার মুল্লুক তার নীতি বহাল রয়েছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার, কথাটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি তখন দেখা যায় কথাটি সেখানেও প্রাসঙ্গিক। পৌরাণিক কাহিনিতে জোর দখলের ইতিহাস রয়েছে। কথিত ধর্মীয় দেবতারাও জোর দখলের প্রতিযোগিতা করেছে। পৃথিবীর কোনো দেশই কারও নিজস্ব সম্পদ নয়। তার পরও রাজা-বাদশাহ বা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী নানাভাবে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে ওই ‘জোর যার মুল্লুক তার, নীতিতেই। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতার যুগেও ‘জোর যার মুল্লুক তার, নীতিই সবাই গ্রহণ করছে। সভ্যতার ধারক মানবজাতি বাহ্বাও দিচ্ছে। এই পৃথিবীতে অস্ত্রে, অর্থে যারা বলীয়ান তারা জোর করে দেশ দখল করছে; পৃথিবীতে খবরদারী করছে আমরা সাধারণ মানুষ নীরব থেকেছি, কোনো প্রতিবাদ করেনি। কেনই বা প্রতিবাদ হবে? এটা তো অন্যায় কাজ নয়। আমার জোর আছে, শক্তি আছে, আমি বিজয়ী। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম সব জায়গায় এটাই ঠিক। জোর যার মুল্লুক তার। একজনের জমি জোর করে দখল করে রাখল, দীর্ঘদিন পর বিচারক দখলদারের পক্ষেই রায় দিয়ে দেবে। বিচারালয়ের সাধারণ প্রশ্ন থাকে দখল কার? দখল যার সম্পদ তার। এই স্লোগান এখন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। আপনি ভোটে জিতবেন? জনতা ভোট দিক আর না দিক আপনি নিজেই যদি পেশী শক্তি ব্যবহার করে ভোট কেন্দ্র দখল করে নিজের পক্ষে ব্যালট পেপার কিংবা ইভিএম টিপতে পারেন, তবে আপনি জিতে যাবেন। সে জন্য আপনার কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। এই যে দেখুন রেসলিং বা কুস্তি এবং মুষ্টিযুদ্ধে যার শক্তি বা জোর বেশি, সেই জিতে যায় আমরা তাকেই স্বীকৃতি দেই। ২০১৮ সালের ১৯ মে ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ‘জোর যার মুল্লুক তার, শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। সেখানে তিনি শুধু ভোট যুদ্ধে যারা জোর জবরদস্তিতে জয় লাভ করে তাদের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু ‘জোর যার মুল্লুক তার, কথাটি সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যার জোর বেশি তার বেতন বেশি। টাকার জোর, গায়ের জোর থাকলে তার আর কিছু দরকার নেই। তিনি ইচ্ছা করলে যা খুশি তা-ই করতে পারেন। পৃথিবী নামক গ্রহটিতে যত দেশ আছে এর কোনোটিই কারো পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। কাজেই জোর থাকলে সব দেশেরই রাজা-বাদশাহ হওয়া কোনো ব্যাপার নয়।

দরকার শুধু জোর বা শক্তি। শক্তি বা জোরের মাধ্যমে আদর্শিক রাজনৈতিক দলও অন্যরা দখলে নিতে পারে। যেমন- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসম্প্রদায়িক আদর্শের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এখন বিভিন্ন জেলা উপজেলায় বিএনপি-জামাতের দখলে চলে গেছে। এ রকম চলতে থাকলে নামে আওয়ামী লীগ; কিন্তু শাসন চলবে বিএনপি-জামাতের। আজ মানবাধিকার বিষয় নিয়ে আমরা খুব মাথা ঘামাই, আসলে জোরই হচ্ছে আসল মানবাধিকার। আমাদের শক্তি থাকলে আমরাও স্যাংশন দিতে পারি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে। শক্তি অর্জন করাই মুখ্যবিষয়। ব্যক্তি জীবন থেকে সামাজিক রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রেই জোর যার মুল্লুক তার নীতিই আদর্শ হিসেবে গণ্য।