গলফ ট্যুরিজমের সম্ভাবনা

মো. জিয়াউল হক হাওলাদার, পর্যটন বিশেষজ্ঞ

প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান বিশ্বে স্পোর্টস ট্যুরিজম বা ক্রীড়া পর্যটনের মধ্যে গলফ একটি গুরুত্বপূর্ণ সেগমেন্ট যা আয়োজক দেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারে।

বাংলাদেশ পর্যটন নীতিমালা ২০১০ অনুযায়ী স্পোর্টস ট্যুরিজমের প্রচার-প্রচারণায় দেশে একটি ভালো গতি পাচ্ছে। ক্রিকেট, ফুটবল, হা-ডু-ডু এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খেলার পর গলফ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় খেলা হিসেবে আভির্ভূত হচ্ছে। এদেশে গলফখেলোয়াড়ের সংখ্যাও বাড়ছে, যার মধ্যে ২-৩ জন খেলোয়াড় এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। একটি বিশেষ পর্যটন সেগমেন্ট হিংেসবে গলফিং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারে। যদিও গলফ পর্যটন পর্যটনের একটি বিশেষ অংশ, এটি বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বিশ্ব গলফ ২০২২ এর পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বে ৩৮ হাজার গলফ কোর্স রয়েছে। বর্তমানে শীর্ষ গলফ গন্তব্য বা দেশগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, নিউজিল্যান্ড, জাপান, উত্তর আমেরিকা, পর্তুগাল, চীন, মালয়েশিয়া ইত্যাদি। গলফ সারা বছরব্যাপী খেলা যায় বলে খেলোয়াড?রা যে দেশে গলফ কোর্স রয়েছে সেই সব দেশে চলে আসে। যখন খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটি গলফ টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়, তখন অনেক গলফপ্রেমিক, স্পন্সর এবং সমর্থনকারী লোকেরা প্রচুর ভ্রমণ করে। গলফ ট্যুরিজমের মার্কেট সাইজ ২০২১ অনুযায়ী ২১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালে হবে ২৩.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । ২০৩৩ সালে এর মার্কেট সাইজ হবে ৪০.০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমান বিশ্বে আনুমানিক ৫৬ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বব্যাপী গলফ খেলে, যার মধ্যে ২৬.৭ মিলিয়ন হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর বাইরে ইউরোপে ৫.৫ মিলিয়ন গলফ খেলোয়াড় রয়েছে। কানাডায় গলফ খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৫ মিলিয়ন, জাপানে ১৪ মিলিয়ন এবং যুক্তরাজ্যে ৩.৮ মিলিয়ন। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ একমাত্র গলফ খেলার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করে এবং তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। গলফ খেলাকে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ পর্যটক আকর্ষণ করার দ্বিতীয় প্রেরণা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর জন্য বিশ্বজুড়ে গত দশকে গলফে বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটিও উৎসাহজনক যে গলফ খেলার পর্যটন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দেশ বিশ্বমানের গলফ কোর্স এবং গলফ রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করছে।

কেনিয়া, বতসোয়ানা, মেক্সিকো এবং অন্যান্য উত্তর-আমেরিকান এবং আফ্রিকান দেশগুলোর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও গলফ রিসোর্ট, গলফ ক্লাব ইত্যাদির মাধ্যমে গলফ কোর্স সুবিধার অফার নিয়ে আসছে। যেখানে একটি গলফ রিসোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শত শত কর্মসংস্থান সরাসরি তৈরি হয়, যেমন- ক্যাডি, মার্শাল, ব্যাগার, প্রশিক্ষক, গলফ কোর্স রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী, খাদ্য ও পানীয় পরিষেবা কর্মী ইত্যাদি।

কোভিড-পরবর্তী সময়ে, ইউএনডবি. উটিও পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আউটডোর এক্টিভিটির উপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং যার মধ্যে গলফ স্পোর্টস এই গুরুত্বের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। যখন একটি গলফ কোর্স প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাকরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়, সেই এলাকায় ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয় এবং তা দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। গলফকে বলা হয় পরিবেশ ও প্রকৃতিবান্ধব খেলা। গলফ কোর্স প্রকৃতিকে রক্ষা করতে সাহায্য করে, কারণ তার নিজের জন্যই সবুজ প্রকৃতি এবং জলাশয়ের প্রয়োজন।

কিছু বিশেষজ্ঞ এরই মধ্যে বাংলাদেশকে গলফ-পর্যটনের হিডেন জেম হিসেবে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এবং এখানে মানুষের ক্রয়ক্রমতা ক্রমেই বাড়তে থাকায় এদেশে গলফ ট্যুরিজমের প্রসারের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক তরুণ-তরুণীদের মধ্যে গলফ খেলায় আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশ বিদেশি গলফ খেলোয়াড়দের ভালো গলফ সেবা দিতে পারে। গলফ ট্যুরিজমই পারে যুবসমাজকে ধর্মান্ধতা এবং ক্ষতিকারক নেশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। বাংলাদেশের ক্রীড়া পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গলফকে অনেক পর্যটন বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বারোপ করেছেন। এখানে অনেক বিনিয়োগকারী আসছেন। গলফ পর্যটনে আরও বিনিয়োগ করা গেলে বাংলাদেশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক লাভবান হতে পারে। এটি ২০৩০ সালের মধ্যে এস.ডি.জি অর্জনে সহায়তা করবে। এস.ডি.জি-৩ বলেছে, সব বয়সের সব মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করুন এবং সুস্থ থাকার জন্য খেলাধুলার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নীতিগুলো প্রচার করুন। খেলাধুলার সঙ্গে যুবকদের সম্পৃক্তকরণ জরুরি, কারণ তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য এটি অপরিহার্য। গলফ খেললে শরীরে ভিটামিন ডি পেতে সাহায্য করে যা কোভিড এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করে। খেলাধুলাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম অর্জনে সহায়তা করে। তাই গলফের উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে আমাদের ক্রীড়া পর্যটনের প্রচার করা উচিত।

বর্তমানে বাংলাদেশে ২০টির মতো গলফ কোর্স রয়েছে যার মধ্যে পাঁচটি ১৮ হোলবিশিষ্ট গলফ কোর্স এবং চৌদ্দটি ৯-হোলবিশিষ্ট কোর্স। ১৮ হোল কোর্সগুলো হলো- (১) ঢাকার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, (২) সাভারের সাভার গলফ ক্লাব, (৩) কুমিল্লায় ময়নামতি গলফ অ্যান্ড কাস্ট্রি ক্লাব, (৪) চট্টগ্রামে ভাটিয়ারি গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (৫) চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন গলফ ক্লাব।

৯ হোলের গলফ কোর্সগুলো হলো- (১) ঢাকার আর্মি গলফ কোর্স, (২) টাঙ্গাইলের ঘাটাইল গলফ কোর্স, (৩) চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় শাহীন গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (৪) খাগড়াছড়িতে চেঙ্গী গলফ কোর্স, (৫) রংপুর গলফ কোর্স, (৬) বগুড়া গলফ কোর্স, (৭) যশোর গ্যারিসন অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (৮) গাজীপুরে বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি গলফ কোর্স, (৯) মৌলভীবাজারের শমসের নগর গলফ ক্লাব, (১০) শ্রীমঙ্গলে গলফ পাহাড়িকা কোর্স, (১১) কক্সবাজার গলফ অ্যান্ড কান্ট্রি ক্লাব, (১২) নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব, (১৩) পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমি গলফ কোর্স, (১৪) খুলনার জাহানাবাদ গলফ কোর্স, (১৫) সাভারের জিরাভো গলফ কোর্স।

বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশন (বিজিএফ) দেশের গলফ কোর্সগুলোর একটি এ্যপেক্স সংগঠন হিসেবে সারাবছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে গলফ পর্যটনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে বাংলাদেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিকমানের টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হলে অনেক আন্তর্জাতিক নামিদামি খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে। বাংলাদেশ গলফ ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে গলফ-প্যাকেজ অফার করা যেতে পারে।

এটি পর্যটন থেকে বর্তমান আয়ের দ্বিগুণ হবে। বৈশ্বিক গলফ ট্যুরিজমের ফিউচার ট্রেন্ডে দেখা যাচ্ছে যে, বার্ষিক ১২ শতাংশ হারে ক্রমেই বাড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে গলফ স্পোর্টসের দিকে নজর দিতে হবে। বিদেশি খেলোয়াড়, স্পন্সর এবং আন্তর্জাতিক গলফ ক্লাব সদস্যদের জন্য উন্নতমানের আবাসন, গলফ কোর্সের সুবিধা এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে হবে। গলফ কোর্স শুধু ক্লাব সদস্য বা পেশাদারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। কর্তৃপক্ষ সৌখিন বা অপ্রাতিষ্ঠানিক গলফারদের জন্য গলফ ক্লাব খোলা রাখার নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সুবিধার জন্য গলফ পর্যটনের উন্নয়ন করা প্রয়োজন। গলফ খেলা আমাদের বাংলাদেশে টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়তা করবে।