ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়

জহুরুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়

মানুষ যখন তার সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে কিংবা আর অন্য কোনো উপায় খুঁজে না পায়, তখন সে আত্মহত্যা নামক ঘৃণ্য পথটি বেছে নেয়। সমাজে চলতে গেলে নানান সমস্যা কিংবা বাধা-বিপত্তি আসে। এর মানে এই নয় যে, নিজেকে আত্মহত্যার মুখে ঠেলে দিতে হবে। প্রতিটি সমস্যারই একটি সমাধান থাকে। অকাল মৃত্যুর মাধ্যমে মুক্তির উপায় না খুঁজে যদি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়, তাহলে এ ধরনের কাজ করার চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসার কথা নয়। জীবনকে নতুন আঙ্গিকে যাপন করার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা উচিত প্রত্যেকের।

আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল মনে করেন, আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের চিত্র। এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন- তখন আত্মঘাতী হয়ে ওঠেন। তবে এসব কারণের মূল উপাদান রাষ্ট্র ও সমাজেই বেশি। মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। পৃথিবীতে নগরেই আত্মহত্যা বেশি ঘটে। প্রযুক্তি যেমন মানুষকে সচেতন করে, তেমনি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে এবং প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। এমনকি বিত্তবানরাও আত্মহত্যা করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করে, যা প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ১৯১ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবিএসের জরিপ বলছে, বছরে আত্মহত্যা করছে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। পুলিশ সদরদপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। ডিএমপির তথ্যমতে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৬টি। ২০২২ সালে মাত্র ৮ মাসে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, যার মধ্যে ১৯৪ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৭৬ জন কলেজ পড়ুয়া, ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ও ৪৪ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বিশেষ করে করোনার সময় আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম বছরে আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭.৩৬ শতাংশ এবং মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি। করোনার সময় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এ সময়ে মানুষের সংকট বেড়েছে, বিষণ্ণতা বেড়েছে। জীবন নিয়ে সংশয় বেড়েছে। বেড়েছে দারিদ্র্য, হতাশা ও শূন্যতাও, যার ফলে আত্মহত্যা বেড়েছে।

আত্মহত্যাকে সংকট হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরকার, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিসহ প্রতিটি স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ জরুরি। উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সবাই যার যার জায়গা থেকে সচেতন হলে এ সমস্যা সহজেই মোকাবিলা করা সম্ভব। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কাউন্সিলিংয়ের সুবিধা বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে। তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না, যাবে না অবহেলা করা। তাদের হতাশার জায়গাগুলো দূর করে সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী করতে হবে। নানান সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমেও এটি কমিয়ে আনা সম্ভব। করোনায় যারা বিষাদ বা হতাশার শিকার হয়েছেন, তারা সবাই তো আত্মহত্যা করেননি। সুতরাং, এখানেই জীবনের প্রতি ভালোবাসার গল্প আছে। আমাদের সেটাই বড় করে দেখা উচিত। তারা তো হতাশাকে জয় করেছেন। আমি মনে করি যে, যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের মধ্যে যথাসময়ে এই জীবনবোধ জাগাতে পারলে দুঃখজনক পরিণতি দেখতে হতো না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত