ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পর্যালোচনা

প্রযুক্তির যুগে বিভক্ত বিশ্ব দেখছে বিশ্ববাসী

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected]
প্রযুক্তির যুগে বিভক্ত বিশ্ব দেখছে বিশ্ববাসী

আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতা, সমাজ, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রভাবে পাল্টে গেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, স্বতন্ত্র সমাজ ব্যবস্থা, যোগাযোগ ও রাজনৈতিক চর্চা। যে জাতির প্রযুক্তি যত উন্নত, সে জাতির বিশ্ব সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রভাবও তত বেশি। যুগ যুগ ধরে মানব সমাজ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়েই মানব সমাজের নিরন্তর অভিযাত্রা; আর এর মোকাবিলার জন্য মানুষের হাতে ছিল নিজেদের একত্রিত হওয়া। একত্রিত মানব সমাজ সব সমস্যা অতিক্রম করতে সক্ষম। যে সমস্যায় সারা মানব জাতি আজ নিমজ্জিত; তাতে একমাত্র একত্রিত হওয়াই একমাত্র সমাধান। আজকের বিশ্ব বহু জাতি-রাষ্ট্রে বিভক্ত-দেশগুলোও সীমানা দিয়ে পরিষ্কার বিভক্ত। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এই সময় সারা পৃথিবীর মানুষ বড় বেশি কাছাকাছি। আর তাই তাদের একত্রিত হওয়া খুবই সহজ একটা বিষয়। দরকার শুধু একত্রিত হওয়ার একাগ্র ইচ্ছা। বলা যায়, সত্তর এবং আশির দশকের মতো স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব। আবার বিভক্ত বিশ্ব দেখছে বিশ্ববাসী। আর এটি আবার নতুন করে উত্তেজনা এবং এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা তৈরি করছে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি অবস্থান, চীনের এক ধরনের নির্লিপ্ততা, চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের উষ্ণতা পুরো বিশ্বকে যেন আবার বিভক্ত করছে, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আর এরকম একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কূটনীতি এক জটিল সমীকরণে দাঁড়িয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য একদিকে। অন্যদিকে, রাশিয়া-চীনের মতো দুই প্রভাবশালী ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন, অন্যদিকে রাশিয়ার সামরিক শক্তি। দুই মিলিয়ে আবার যেন শীতল যুদ্ধের সময় শুরু হয়ে গেল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর আগের মতো নেই। একসময় তাদের যে অর্থনৈতিক শক্তি ছিল, সামরিক দর্প ছিল তা চুরমার হয়ে গেছে আফগানিস্তানে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শক্তি বলতে মার্কিন সহায়তা ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। যুক্তরাজ্যও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এখন একটু খর্ব শক্তির অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। তার পরও বিশ্বের মোড়লিপনায় এই পশ্চিমা দেশগুলো এগিয়ে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ অনেক গুণ বাড়িয়েছে। রাশিয়া বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করছে, বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইটের কাজ পেয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া বাংলাদেশের একাত্তরের পরীক্ষিত বন্ধু, তাই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ দ্বিধান্বিত নয়। কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতার কারণে বাংলাদেশ দ্বিমুখী সংকটে পড়েছে। একদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশকে এখন সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, ভারতের মধ্যেও এক ধরনের অস্বস্তি দানা বেঁধেছে।

এরকম একটি পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। সামনে যখন বিশ্বে বিভক্তি আরো বাড়বে, শীতল যুদ্ধের অবয়ব যখন আরো গাঢ় হবে তখন বাংলাদেশের ওপরও চাপ বাড়তে পারে বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাই বাংলাদেশেকেই এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন পথে যাব, আমাদের গন্তব্য কোথায়।

এই মেরুকরণে বাংলাদেশকে এখন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। বিশ্ব এখন স্পষ্টত বিভক্ত। পূর্ব আর পশ্চিম। অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বিশ্ব এখন এই দুই মেরুতে বিভক্ত। একদিকের নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। অন্যদিকে চীন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য পূর্বদিকের অনেক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশ। আর চীন বলয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারসহ বেশ কিছু দেশ।

ক্রমাগত বিশ্বে কর্তৃত্বের লড়াই চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হলেও চীন এগুচ্ছে কৌশলে। অনেকটা নীরবে। তার প্রমাণ ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবকে মিলিয়ে দেয়া। এ বছর মার্চ মাসে ওই দুই দেশের নতুন দোস্তির ঘোষণা দেয়ার আগে কেউ এমনটা আঁচ করতে পারেননি। একে একে এশিয়া, তথা পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ঋণ দিয়ে, একের পর এক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন তার আধিপত্য বাড়াচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ভিন্ন। তারা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীনের এই মাতব্বরি মেনে নিতে পারছে না।

এ নিয়ে ভারতের পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে।

এশিয়ায়, তথা ভারতীয় উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে চীন। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় থাবা বিস্তার করেছে। হাম্বানটোটা বন্দর চীনের নিয়ন্ত্রণে। অনেকটাই চীন ও রাশিয়ানির্ভর হয়ে পড়েছে পাকিস্তান। সম্ভবত এ কারণেই তাদেরকে ঋণ দিতে একের পর এক শর্ত আরোপ করছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের দহরম-মহরম। তাছাড়া অন্য অনেক দেশে চীন তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। এমনকি বাংলাদেশেও বড় বিনিয়োগ করেছে চীন।

তারা সামনে আরও বিনিয়োগের জায়গা খুঁজছে। এসব বিষয় ভারতের ইমেজের জন্য ক্ষতিকর। ভারতীয় উপমহাদেশে চীনের এই আধিপত্য ভারতের জন্য সহনীয় নয়। তাই তাদের পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে হচ্ছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি বদলে গেছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য চলে যাচ্ছে চীনের বলয়ে।

জুনের শুরুতে চীনের ন্যাশনাল এনার্জি এডমিনিস্ট্রেশনের প্রশাসক ঝাং জিয়ানহুয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সৌদি আরবের জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রী। এবার তার প্রতিনিধি দলসহ রিয়াদের আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে জ্বালানির বিভিন্ন খাতে সম্পর্ক শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত। এর উদ্দেশ্য সৌদি ভিশন-২০৩০ এবং চীনের বিআরআই এবং তাদের নেতৃত্বে আরব দেশগুলোও যুক্ত হয়েছে।

বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা বিরাজমান। সেখানে তাইওয়ানের সরাসরি পক্ষ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে আছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া। তাইওয়ানকে দখল করে নেয়ার জন্য প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এর ঠিক বিপরীত অবস্থান চীনের। ফলে বিশ্বের বড় দুই পরাশক্তি শুধু এখানেই যে মুখোমুখি তা নয়, তারা নানা দিক থেকে বিপরীত মেরুতে।

টিকে থাকার এই কঠিন সময়ে শুধু নিজ স্বার্থ রক্ষা ছাড়া আর কোনো কিছুই বিবেচ্য নয়। আর যারা এর বিপরীত তারা আর টিকতে পারছে না। যেমনটি ক্রমাগত ভাগ হয়ে যাচ্ছে ইথিওপিয়া আর সুদান; বিভক্ত হয়ে গেছে পূর্ব তিমুর। আর শাসকরা তো বিবেচ্যই নয়; শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে আর অতীত, পাকিস্তানের ইমরান খান মামলা আর হামলায় বিপর্যস্ত। আর নিজ স্বার্থ রক্ষাই মূল বিবেচ্য নয়; বরং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির ব্যবসা-বাণিজ্যই প্রধান। যে সরকার যত বেশি মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে তারা তত বেশি সময় টিকে থাকবে। একক বিশ্বব্যবস্থা কায়েমের তিন দশক পর বিশ্ব অতিমারির অভিঘাত আর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমরা একটা অতি কঠিন সময় পার করছে। বিশ্ব আজ গণতন্ত্র হতে বহুদূরে; সরকারগুলো যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বিশ্ববাজারে আগুন আর বিতরণ ব্যবস্থার নতুন সমীকরণ বেশির ভাগ দেশ আর সাধারণ মানুষদের এমন একটা কঠিন অবস্থায় নিয়ে গেছে যে বেশির ভাগ মানুষ আজ যেন অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। সমস্যাটি সারা মানব জাতির- তাই পুরো বিষয়টি একটি সামগ্রিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা দরকার। কারণ, সমগ্র মানুষের নিজের রক্ষার জন্যই সবার বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে হবে। যদি কোনো দেশ বা অঞ্চলের মতো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বাকি মানুষদের ক্ষেত্রে অনেক বড় অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে।

বর্তমান সময়ে একটি বড় রাষ্ট্র রাশিয়া তার আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ইউক্রেন আক্রমণ করেছে, যা ওই অঞ্চলে একটি ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। যদি বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হতো অবশ্যই যুদ্ধটি আর সৃষ্টি হতো না। পৃথিবীর শাসন ব্যবস্থার দিকে তাকালে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার সেটা হলো, ক্ষমতায় থাকে অল্প কিছু মানুষ আর বেশির ভাগ মানুষকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে। আর এ ব্যবস্থায় মূলত সম্পদ অতি অল্প কিছু মানুষের হাতে জমা হতে থাকে। এটাই আধিপত্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার মূল বিষয়। অল্প কিছু মানুষ একটা বিশাল সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে- এটাই বর্তমান শাসন ব্যবস্থার আসল রহস্য। আর তাই, এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থই রক্ষিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে এই অবস্থার স্থায়িত্ব যত বেশি থাকবে, ততই সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে। আসলে এর শেষে কখনোই ভালো কিছু নেই। ভালো কিছু পেতে সাধারণ মানুষকেই উদ্যোগী হয়ে একটি আন্তরিক আর অব্যাহত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

আর অবশ্যই সাধারণ মানুষকে একতাবদ্ধ হতে হবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য। আধিপত্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা আজ একটা সন্ধিক্ষণে উপস্থিত। অল্প কিছু মানুষ সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে এমন একটা সময়ের সামনে উপস্থিত হয়েছে যে, এর নায্যতা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

এই ব্যবস্থাটি যে আর ভালোভাবে কাজ করছে না, তা আজ পরিষ্কার। বিগত দুই দশকে বিশ্ব একটি একক বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্গত থেকে ক্রমাগত ব্যবসা আর মুনাফাকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষের অধিকারগুলোকে সংকুচিত করে ফেলেছে। ফলে এর সঙ্গে কোনো ধরনের সমন্বয় করে আরো কিছুদিন চলার কোনো সুযোগ নেই। দরকার এর আমূল পরিবর্তন; নতুন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা, যার মূলে থাকবে বেশির ভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। বিশ্ব আজ একটা তথ্য জালের অন্তর্গত; তাই সহজেই সবাই একত্রিত হয়ে আরেকটি বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টি খুব একটা কঠিন নয়। এই একত্রিত প্রচেষ্টা বিশ্বমানবতার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়; আর এটাই হোক বিশ্বব্যবস্থার সত্যিকার বিকল্প।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত