ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জলবায়ুর পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
জলবায়ুর পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা

একুশ শতকে জলবায়ুগত পরিবর্তন সভ্যতার সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কার্বন নির্গমনের ব্যাপারে ‘নেট জিরো’ অর্থাৎ যে পরিমাণ গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে এবং যে পরিমাণ বায়ুমণ্ডল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে সাম্যাবস্থার লক্ষ্য এখন প্রায় সর্বজনীন স্তরে গৃহীত সিদ্ধান্ত। এই উদ্যোগ থেকে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের দ্বারা অর্থনীতির সামগ্রিক বদলের সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে।

কার্যত প্রায় সব রকমের শিল্পক্ষেত্রেই এই পরিবর্তন বিপুল বদল আনতে সমর্থ এবং এই পরিবর্তন পরিবেশ সংক্রান্ত বাণিজ্য, যেমন সৌরশক্তি উৎপাদনের প্যানেল নির্মাণ বা ব্যাটারি তৈরির মতো ক্ষেত্রকে আরও বেশি উদ্দীপিত করতে পারছে। মাইক্রোচিপ উৎপাদনের মতো ব্যবসা, যেখানে বিপুল পরিমাণ শক্তি ও সেই সঙ্গে বিশেষ ধাতুর প্রয়োজন পড়ে, সেখানে এই পরিবর্তন গতি নিয়ে আসতে সমর্থ হবে। গ্যাস ও খনিজ তেল সংবহনের জন্য ব্যবহৃত পুরোনো হাইড্রোজেন পাইপলাইন গ্রিডগুলো বদলে নতুন গ্রিড লাগানো এবং সর্বত্র চার্জিং স্টেশন স্থাপনের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন। এ অবস্থায় এ কথা ভাবা অসম্ভব যে, কোনো বড় শিল্পক্ষেত্র এই পরিবর্তনের আঁচ থেকে দূরে থাকবে। সার উৎপাদনে ‘গ্রিন অ্যামোনিয়া’-র সন্ধান চালু থাকবে বা জীবাশ্মজলত আলানির ব্যবহারের পরিবর্ত খোঁজা শুরু হবে। এই সব দেখে দু-এক দশকের মধ্যে অর্থনীতির পরিচিত চেহারাটি আমূল বদলে যেতে পারে বলেই মনে হয়।

যুক্তিসংগতভাবেই প্রায় প্রতি সপ্তাহে সংবাদ শিরোনামে যেন পরিবর্তনের জন্য নির্দেশিকা উঠে আসছে। পাকিস্তানে হঠাৎ হওয়া বন্যা পরিস্থিতিতে সে দেশের অর্থনীতির প্রায় ৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে এই ক্ষতি ৫০ শতাংশে গিয়েও ঠেকতে পারে। অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষির ক্ষেত্রে বীজ বোনার প্রচলিত ব্যবস্থাকেই বদলে দিয়েছে, অরণ্যগুলোতে দাবানলের প্রবাহ তৈরি করছে, ব্রিটেনের মত ‘শীতের দেশ’-এ বাংলাদেশের মতো প্রখর গ্রীষ্মের সৃষ্টি করেছে। হিমালয়ে হিমবাহের গলন, দক্ষিণ মেরুর বরফের রাজ্যে সুবিশাল ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি এবং সব রকমের প্রাণীর স্বাভাবিক বাসভূমি যেভাবে শীতলতর এলাকা থেকে উষ্ণমণ্ডলের দিকে চলে যাচ্ছে, তাতে কখনও কখনও মনে হতে পারে, এই বুঝি সৃষ্টির অন্তিম লগ্ন সমাগত। শেষের সে ভয়ংকর দিন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে।

এই সব কিছু মাথায় রেখে কেউ যদি বৃহৎ সংস্থাগুলোর দ্বারা ঘোষিত বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলোর দিকে নজর করলে দেখতে পাবেন, জলবায়ুগত পরিবর্তনের বিষয়টি প্রায় সব জায়গাতেই উপস্থিত। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি এবং স্কুটার নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ এবং উদ্যোগ বাড়ছে, রেল পরিবহনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশনের দিকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে, সৌর এবং বায়ুশক্তি উৎপাদক ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটানো হচ্ছে, ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’ উৎপাদনের লক্ষ্যে সেগুলোর ব্যবহার বাড়ছে। এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে, একেবারে প্রথাসিদ্ধ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পরিবেশগত ভাবনার প্রয়োগ নিয়মিত হয়ে পড়েছে। শক্তির ন্যূনতম ব্যবহারের প্রতি তারা সজাগ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে নজর দিচ্ছে যাতে বর্জ্যের পরিমাণ কমে। উপাদান-নিবিড় উৎপাদন থেকে তারা সরে আসছে। সিমেন্ট থেকে ইস্পাত, ভোগ্যপণ্যের প্যাকেজিং, এমনকি, জাহাজে পাঠানোর ক্ষেত্র পর্যন্তÍ সব কিছুই এই পরিবর্তনের অঙ্গ।

মানবিক কার্যকলাপকে কার্বনমুক্ত করার প্রক্রিয়া দাঁড়িয়ে থাকবে ডিজিটাইজেশন, সংযোগ এবং ডেটাবিপ্লব দ্বারা এরই মধ্যে প্রস্তুত মঞ্চের ওপর। এর ফলে প্রাত্যহিক যোগাযোগ পরিণতি পাবে ভার্চুয়াল বৈঠকে। টেলিমেডিসিন এবং এমনকি (যদিও এর মধ্যে খানিক সন্দেহের গন্ধ থেকেই যায়) শিক্ষা ও সেই সঙ্গে ব্যাংকিংয়ের মতো ক্ষেত্রেরও ক্রমশ ভার্চুয়াল হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এই কার্বনমুক্ত জীবনযাত্রার সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়েছে। কোভিড অতিমারি এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে।

এ সব কিছু থেকে জীবনযাপনের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। মহানগর থেকে দূরে এক নতুন এবং অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব এলাকায় উপযুক্ত পরিকাঠামোসহ গড়ে উঠবে নয়াবসত। দ্রুতগামী আন্তঃশহর ট্রেন পরিষেবা চালু হলে সেখানকার যাপন আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য হয়ে উঠতে পারে।

সিলেট বা রাজশাহী তুলনামূলকভাবে মন্থর জীবনে যে আরাম পাওয়া যেতে পারে, দরকার পড়লে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে যে জীবন থেকে ঢাকার মহানাগরিক পরিসরে পৌঁছনো যেতে পারে, সেই জীবনকে কেন মানুষ বেছে নেবেন না? অথবা ঢাকার মতো মহানগরের প্রায় হাতায় অবস্থিত গাজীপুরে বাস করেও ঢাকায় তো একই রকম স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যেতে পারে! সেখান থেকে ঢাকায় এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছনো যায়।

সংকট এবং সুযোগ-সুবিধার সহাবস্থান বহু রাষ্ট্রকেই অর্থনৈতিকভাবে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। শুধু সংকট এতখানি পেরে উঠত কি-না সন্দেহ যদিও লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। ইনসেন্টিভ এবং ভর্তুকি প্রদান করে কাঙ্ক্ষিত ধাঁচের বিনিয়োগকে সম্ভব করে তুলেছে। প্রার্থিত এলাকাটি দিল্লির চেয়েও সামান্য বড়। শুধু আম্বানি আর আদানি বা টাটাই নয়, ইন্ডিয়ান অয়েল বা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের মতো সরকারি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, লারসেন অ্যান্ড টুর্বো, রিনিউ পাওয়ার ইত্যাদিও নতুন সুযোগের সন্ধান করছে এই বিশেষ ক্ষেত্রে। এমনকি, পরিবহন পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ‘ওলা’-ও বৈদ্যুতিক স্কুটার তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। হোম ডেলিভারির ব্যাপক চল খুচরো ব্যবসার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে।

এই আপাদমস্তক পরিবর্তনে কিছু শিল্পক্ষেত্র যে সমস্যায় পড়বে, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। পর্যটন ও হোটেল ব্যবসা, অফিস সরঞ্জামের বাজার এর দ্বারা এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের কারণে। বাণিজ্যিক রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলো তাদের দপ্তরের আয়তন কমাচ্ছে অথবা একেবারেই উঠিয়ে দিচ্ছে। সেই সব শূন্যস্থানে শহর থেকে দূরে বাসরত মানুষ সাময়িকভাবে ঘর ভাড়া নিচ্ছেন। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা তার সুযোগ খুঁজে নিচ্ছে শহরের বাইরে। এমনকি, শহরতলিও পার হয়ে নতুন জনবসতি নির্মাণের মাধ্যমে, যেখানে সচ্ছল মানুষ তাদের নিজস্ব ছন্দে বাঁচতে পারবেন। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পরিবর্তনের এই খেলায় বাংলাদেশ অনেক দেরিতে যোগ দিয়েছে আর সেই কারণেই সে এক অপরিকল্পিত সুবিধা লাভ করছে। প্রাচীনের খুব কম অংশকেই ধ্বংস করে নতুনের আগমনের পথ প্রশস্ত করার সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত