প্রতারণা, সচেতনতা ও প্রতিকার

আখতার হোসেন আজাদ, অ্যাক্টিভিস্ট, কনাশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস)

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ল্যাপটপে হঠাৎ চার্জ না হওয়ার দরুন গত ১৯ জুন গিয়েছিলাম স্থানীয় একটি কম্পিউটার সার্ভিসিং সেন্টারে। দোকানি ল্যাপটপ খুলে পরীক্ষা করার পর আমাকে বললেন, ল্যাপটপের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে। এটি পরিবর্তন করতে হবে। আমি তাদের পরামর্শ মোতাবেক ল্যাপটপের ব্যাটারি পরিবর্তন করতে সম্মত হই। তাদের কাছে আমার ল্যাপটপের মডেলের ব্যাটারি না থাকায় তারা জানায় এটি ঢাকা থেকে আনতে হবে। অর্ডার কনফার্ম করার জন্য মিনিমাম কিছু টাকা অগ্রিম দিতে হবে। আমি তা পরিশোধ করি।

তিন দিন পর তারা আমাকে জানায়, ব্যাটারি চলে এসেছে। আমি আমার ল্যাপটপ নিয়ে তাদের সার্ভিসিং সেন্টারে গেলে ল্যাপটপে নতুন ব্যাটারি সেট করে। কিন্তু তাতেও চার্জি সমস্যার সমাধান হয়নি। তারা আমাকে জানায়, ঢাকা থেকে আসা ব্যাটারিটি নষ্ট এবং এটি আবারো ঢাকায় রিটার্ন পাঠানো হবে। দুই থেকে তিন দিন সময় লাগবে।

চারদিন পেরিয়ে গেলেও আমি তাদের ফোন না পেয়ে বারবার ফোন করি। বেশ কয়েকবার ফোন দেয়ার পর তারা রিসিভ করলে আমাকে জানায় যে, আগামীকাল ব্যাটারি আসবে।

পরের দিন আবারো আমি তাদের ফোন দিলে তারা জানায়, ব্যাটারি এসেছে। আমি ল্যাপটপ নিয়ে তাদের সার্ভিসিং পয়েন্টে গেলে তারা আবারো ব্যাটারি পরিবর্তন করে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তারা আমাকে জানায়, আসলে আমার ল্যাপটপের ব্যাটারির কোনো সমস্যা হয়নি। ল্যাপটপের হার্ডওয়্যারের সমস্যা হয়েছে। ল্যাপটপ ঢাকায় পাঠাতে হবে।

ব্যক্তিগত ল্যাপটপ কুরিয়ারের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠাতে আমি সম্মত হইনি। আবার তাদের সার্ভিসিং সেবার প্রতিও আমি আর আস্থা রাখতে পারিনি। তাই আমি তাদের বললাম, আমি বাইরে থেকে আমার ল্যাপটপ সার্ভিসিং করিয়ে নেব। আপনারা ল্যাপটপের ব্যাটারি ফেরত নিয়ে আমাকে মূল্য ফেরত দেন।

তারা আমাকে জানায়, কোনোভাবেই আর ব্যাটারি ফেরত নেওয়া যাবে না। আর সার্ভিসিং তাদের থেকেই করতে হবে। অনাস্থার দরুন আমি কোনোভাবেই তাদের আর সেবা নিতে সম্মত হইনি। আমি তাদের বললাম, আমি কুরিয়ার সার্ভিস চার্জ দিতে সম্মত আছি। তবুও এটি ফেরত নেন। কিন্তু তারা কোনোভাবেই ব্যাটারি ফেরত নিতে রাজি হয় না। তারা আমাকে শর্ত দেয় দুটি। হয় তাদের থেকেই সার্ভিসিং করিয়ে নিতে হবে অথবা ব্যাটারির তিন ভাগের এক ভাগ টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ কর্তন করা হবে। অনেক অনুরোধের পরও তারা ব্যাটারি ফেরত নিতে রাজি না হওয়ায় আমি বাড়িতে ফিরে আসি।

বাড়ি এসে সিদ্ধান্ত নিই, আমার সঙ্গে এমন প্রতারণার জন্য আমি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করব। আমি তাদের স্বত্বাধিকারীকে ফোন দিই। অনুরোধের সুরে বলি, ভাই আমি তো ব্যাটারি কিনতাম না। আপনারা পরামর্শ দিয়েছেন। তাই কিনেছি। আমার ব্যাটারির তো কোনো সমস্যা নেই। অনুগ্রহপূর্বক ব্যাটারি ফেরত নিয়ে আমাকে ব্যাটারির মূল্য ফেরত দেন। শত অনুরোধের পরেও তিনি রাজি না হওয়ায় আমি তাকে বলি, যদি আপনারা আমার ব্যাটারির মূল্য ফেরত না দেন, তাহলে আমি ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ জানাব। জবাবে তিনি আমাকে বললেন, আপনার যা ইচ্ছে করেন। পারলে কিছু করে নেন। তারপর তিনি ফোন কেটে দেন।

মিনিট দশেক পর তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে আরেকজন ফোন দিয়ে বলেন, ভাই আপনার ল্যাপটপ আগামীকাল নিয়ে আসেন। আরেকবার চেষ্টা করে দেখি আমরা। আমি তাতে রাজি হলাম।

পরদিন সকালে তারা আমাকে ফোন দিয়ে ব্যাটারির সম্পূর্ণ মূল্য ফেরত নিয়ে যেতে বলে। এমনকি কোনো কুরিয়ার চার্জও লাগবে না বলে জানায় এবং আমাকে সম্পূর্ণ টাকাই ফেরত দেয়।

ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ মোতাবেক আমার সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ড শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথমত তারা প্রতিশ্রুত সেবার বদলে আমাকে হয়রানি করেছে; যা ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ এর ৪৫ নং ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্বিতীয়ত, তারা ব্যাটারি ফেরত না নিলে আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতাম; যারা ৫৩ নং ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে আমার জানা আছে বিধায় আমি নিশ্চিত প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের উচিত ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখা।

প্রায়ই দেখা যায়, নিত্যপণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে কোনো কোনো দোকানি পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। আবার কখনো দ্রব্যের মূল্যও প্রদর্শন করে না। কখনো বা পণ্যের গায়ে বা মোড়কে নির্ধারিত মূল্যের ওপর নিজেদের ইচ্ছে মতো মূল্যের স্টিকার বসিয়েও পণ্য বিক্রি করা হয়। সচেতনতার অভাবে ভোক্তারা তথা দেশের সাধারণ নাগরিকরা এভাবেই নিত্যদিন প্রতারিত হচ্ছেন।

কখনো কখনো দোকানিকে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বা অন্যান্য কোনো পণ্য বিক্রি করতে দেখা যায়। কোনো কিছু কেনার সময় অবশ্যই সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত পণ্যের মোড়কে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যটি উৎপাদনের উপাদান এবং বিএসটিআইর সিল আছে কি-না তা পরীক্ষা করে নেয়া। আবার বিভিন্ন উৎসবে বাড়ি ফেরার সময় বাসের টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য ধার্য, নানা সময়ে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিশ্রুত সেবা না পেলেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যায়। ভোক্তারা একটু সচেতন হলেই নিত্যদিন প্রতারিত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

কোনো নাগরিকের ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হলে তিনি কয়েকটি সহজ পদ্ধতির যেকোনো একটির মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইন নম্বর ১৬১২১ অথবা অনলাইনে dncrp.com ঠিকানায় অথবা মহাপরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সরাসরি উপস্থিত হয়ে অথবা ইমেইল, ফ্যাক্স বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বিস্তারিত লিখে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে লিখিত অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগের সঙ্গে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের রশিদ সংযুক্ত করতে হবে।

২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জনবান্ধব এই আইনটি প্রণয়ন করলেও পর্যাপ্ত প্রচারণার দরুন দেশের সিংহভাগ মানুষ ভোক্তা হিসেবে নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। সরকারকে ভোক্তা অধিকার ও ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। মসজিদ, মন্দিরসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এ সম্পর্কে বহুল প্রচারণা চালাতে হবে।

দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রবল জনবল সংকট রয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। অনতিবিলম্বে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে লোকবল বৃদ্ধি করতে হবে। বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় ও এসব মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরকে সমন্নয়ের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার ও খাদ্যে ভেজাল রোধে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশের জনগোষ্ঠীকে অধিকার সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তা হবে অন্তরায়।