পরিবার থেকে ছিটকে পড়ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠী

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, সাবেক প্রকৌশলী ও শিক্ষক, ঢাকা

প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জল-হাওয়া-কাদামাটির এই দেশের কোমল হৃদয়ের মানুষগুলো দিন দিন কেমন বদলে গেল। এক এক করে ভেঙে গেল যৌথ পরিবার। দাদা-দাদী, চাচা-চাচির সঙ্গে একত্রে মিলে মিশে বসবাস করা পরিবার আজ এ সমাজ-সংসারে নেই বললেই চলে। এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের একত্রে বসবাস করা যেন অলীক স্বপ্ন হয়ে গেছে। দেশের সমাজকাঠামো এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, ছেলেমেয়েরা পূর্ণবয়স্ক হলে মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা নিজের মতো করে আলাদা থাকে, নিজের পছন্দমতো জীবনযাপন করে। প্রবীণ মা-বাবাকে স্বাভাবিকক্রমেই অন্যত্র একা থাকতে হয়। অনেক কষ্টে সন্তানকে লালনপালন, তাকে কর্মক্ষম করে তোলার পর বাবা-মা তাদের সান্নিধ্যটুকু আশা করেন। আজকের বেশির ভাগ বাবা-মা অবশ্য সন্তানের কাছ থেকে তেমন আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা আশা করেন না। বৃদ্ধকালে খেয়েপরে চলার মতো আর্থিক সঙ্গতির ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখেন। কিন্তু সন্তানের সান্নিধ্য বঞ্চিত বাবা-মা বৃদ্ধ বয়সে অসহায়ত্বের মাঝে পড়েন। কখনো সন্তান দ্বারা হন নির্মমতার শিকার। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবহেলা কখনো নিপীড়নের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। বয়স বেড়ে গেলে কেউ তাদের কাছে টেনে নিতে চায় না। কখনো বোঝা মনে করে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। পরমাত্মীয় এ সময় হয়ে যান পর। অর্থবিত্তহীন পরিবারের প্রবীণরা বড্ড বেশি অসহায়। শরীরে যতদিন শক্তি থাকে সারা দিন ঘাম ঝরিয়ে কোনমতে দুবেলা অন্নসংস্থান করতে হয়। আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে শেষ হয়ে যায় জীবনের সকল আয়োজন। অর্থের অভাবে সন্তানের উপযুক্ত শিক্ষাদানও সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে বড় হয়ে এসব সন্তানরা ইচ্ছে থাকলেও প্রবীণ মা-বাবাকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে না। আর সামর্থ্যবান সন্তানরা কখনো প্রবীণ পিতা-মাতার দেখভালের প্রয়োজনই মনে করে না। দীর্ঘ সময় সন্তান ও মা-বাবা আলাদা থাকায় তাদের মধ্যে মায়া-মমতা, শ্রদ্ধাবোধের বন্ধন ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে নিজে সুখে থাকতে চায়।

বাংলাদেশে এ ধরনের প্রবীণদের রয়েছে অনেক দুঃখ-দুর্দশা আর বিড়ম্বিত জীবনচিত্র। এই তো বেশি দিন আগের কথা নয়, এক বৃদ্ধ শিক্ষক পিতার দুই সক্ষম কন্যা চিকিৎসার নাম করে বাবার সব অর্থ হাতিয়ে নিয়ে তাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে যায়। পরে সেই হতভাগা প্রবীণ পিতার ঠাঁই হয় কোনো এক বৃদ্ধাশ্রমে। এছাড়া নড়াইলের লোহাগড়ার অশীতিপর বৃদ্ধা হুজলা বেগম বাংলাদেশের বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মর্মান্তিক জীবনের মূর্ত প্রতীক হয়ে রয়েছেন। মায়ের ভরণ-পোষণ দিতে না পারার অজুহাতে ৮৬ বছর বয়সি স্বামীহারা, তিন ছেলে ও দু’মেয়ের জননী বৃদ্ধা হুজলা বেগমকে তার পুত্র ও পুত্রবধূ রাস্তা দিয়ে টেনেহিঁচড়ে রাতে বাঁশবাগানে ফেলে রেখে যায়। খোলা আকাশের নিচে রাতভর পড়ে থাকা বৃদ্ধা হুজলার ক্ষতবিক্ষত শরীর পিঁপড়া, পোকায় কামড়ায়। পরে তার স্থান হয় লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। অথচ এই মা তার চিরন্তন ভালোবাসা, অকৃত্রিম স্নেহ, মমতা দিয়ে কত দুঃখকষ্ট সহ্য করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন সন্তানের ভবিষ্যৎ, নিরাপদ করেছেন তাদের অনাগত আগামী। হুজলা বেগমের মতো আরও অনেকের বেদনাদায়ক জীবনের শোকগাথা রয়েছে আমাদের হৃদয়পঞ্জিতে। সারা বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠী কমবেশি অবহেলিত। কেউ সহজে মরতে চায় না, সুন্দর এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে চায় না কেউ। কিন্তু দীর্ঘকাল যারা বেঁচে থাকেন, শেষ জীবন বেশির ভাগেরই কাটে বড় কষ্টে। আঠারো কোটি মানুষের এ বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা অনেক; কিন্তু বিত্তশীল প্রবীণের সংখ্যা হাতেগোনা। দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ প্রবীণই হয়ে পড়েন সহায়-সম্বলহীন। বাংলাদেশে ষাট বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষকে প্রবীণ ধরা হয়। সে হিসেবে দেশে এখন প্রবীণের সংখ্যা দেড় কোটি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ার কারণে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০৫০ সালে তা বেড়ে প্রায় ৪ কোটিতে পৌঁছে যাবে। বাংলাদেশের বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশের আয়ের নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেই। পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণই দরিদ্র এবং ৪৮ শতাংশ প্রবীণের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই।

আগের দিনগুলোতে এ দেশের মানুষ বেড়ে উঠেছে যৌথ পরিবারে। মা-বাবা, ভাই-বোনের পাশাপাশি চাচা-চাচি, দাদা-দাদি নিয়ে থাকত বিশাল সংসার। পরিমিত খাওয়া-দাওয়া, রুটিনমাফিক চলাফেরার মধ্যে বেড়ে উঠতে হতো সবাইকে। যৌথ পরিবারে ছিল স্নেহ-আদর-ভালোবাসা-শাসনের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এরই মাঝে গড়ে উঠেছে একের প্রতি অপরের সহমর্মিতা। অন্যের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। অনাবিল আনন্দে কখন কে বড় হয়ে গেছে টেরই পাওয়া যায়নি। বড় হয়ে চাকরি পেয়ে বেতনের টাকা থেকে বাবা-মায়ের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব-কর্তব্যবোধের তাড়না অনুভব হতো। সম্ভব হলে তাদের কাছে রেখে যত্ন, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চাইতো মন। একান্নবর্তী পরিবারে প্রবীণদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক। পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থায় ও আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে এসব আজকাল যেন স্বপ্ন হয়ে গেছে।

দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, চাকরিগত ও অন্যান্য পরিবর্তিত পেক্ষাপটে বাঙালির ঐতিহ্যমণ্ডিত সময়টা যেন দ্রুত পাল্টে গেল। বিশ্বায়নের এ যুগে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে গড়ে উঠেছে একক পরিবার। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আত্মীয়পরিজন। মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পরিবারগুলো থেকে প্রবীণরা ছিটকে পড়েছেন। সন্তানের মায়ার বাঁধন ছেড়ে পড়ে গেছেন আলাদা এক অনিশ্চিত ভুবনে। সেখানে আছে শুধু অনিশ্চয়তা, দারিদ্র্য, নিরাপত্তহীনতা। যাদের অর্থ আছে তারাও সুখে নেই। তাদের রয়েছে সীমাহীন নিঃসঙ্গতার দুঃসহ যন্ত্রণা, একাকিত্বের ভয়ংকর বোঝা। বার্ধক্যকালীন সময়ে মানুষের জীবনে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে। আর এই পরিবর্তনই তাদের মাঝে এনে দেয় সামগ্রীক অসুস্থতা। আর এই অসুস্থতার কারণে সৃষ্ট শারীরিক অসমর্থতা তাকে অন্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে।

বর্তমান সমাজ-সংসারে প্রবীণরা অনেক ক্ষেত্রে বিবেচিত হচ্ছেন বোঝা হিসেবে।

সচ্ছল সন্তান থাকা সত্ত্বেও হতভাগা কোনো প্রবীণকে ভিক্ষা করে জীবন কাটাতে হচ্ছে। কারো স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। বাংলাদেশে বর্তমানে বার্ষিক জন্মহারের তুলনায় প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। কাজেই প্রবীণের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে সচ্ছল এবং দরিদ্র উভয় শ্রেণির প্রবীণদের নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য প্রবীণ জনগোষ্ঠী এক বিশাল ঝুঁকি। তারা দেশ ও সমাজকে কিছু দিতে পারে না, অথচ তাদের জীবন-যন্ত্রটিকে চালানোর জন্য জ¦ালানির তো দরকার। প্রবীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা অধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাদের জন্য স্বল্পশ্রমের উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আর্থিক সংকট দূর করা যেতে পারে। তাতে তাদের কর্মব্যস্ততার মাঝে মনের খোরাকও মিলবে। আর এজন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রবীণদেরকে পরিবারের সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। প্রবীণদের আর্থসামাজিক অবস্থান সব ধরনের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রবীণদেরকে পরিবার ও সমাজে অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং বঞ্চনার শিকার হতে হয়।

আমেরিকা, ইউরোপের মতো উন্নত দেশে অনেক আগেই ‘ওল্ড হোম’ চালু হয়েছে। আজ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর ছাড়িয়ে মফঃস্বল শহরেও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আশ্রয়হীন, স্বজনবিহীন প্রবীণদের শেষ ভরসা এসব বৃদ্ধাশ্রম। উৎসব-পার্বণের দিনগুলোতে এসব প্রবীণদের দেখানো হয় টেলিভিশন প্রোগ্রামে। এদের অনেকের সন্তানই বড় চাকরি কিংবা ব্যবসা করে। একই শহরে থেকেও সেখানে বাবা-মাকে সঙ্গে রাখতে চায় না। তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে, বাবা-মায়ের ব্যয়ভার বহন করে দায়িত্ব পালন করতে চায়। ক’দিন আগে পালিত হলো বিশ্ব প্রবীণ নিরাপত্তা দিবস। শুধু দিবস পালন ছাড়া প্রবীণের জীবনের নিরাপত্তার কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ কি রাষ্ট্র গ্রহণ করে! মা-বাবাকে সন্তানের কাছে রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়াও প্রবীণ মা-বাবার বার্ধক্যে দায়িত্ব গ্রহণ, তাদের যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়া সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবারে প্রবীণ মা-বাবার অবস্থান সুদৃঢ় করা, মর্যাদা সমুন্নত রাখা সন্তানের একান্ত কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্যটি পালন করতে হবে একান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, উন্নত পরিবেশে বসবাস, উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদানের দায়ভার সন্তানকে নিতে হবে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে প্রবীণদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু বিশেষ দিনে বাবা দিবস বা মা দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পরিবারের ছেলে-মেয়েদের শৈশবকাল থেকেই গুরুজনকে ভক্তি, শ্রদ্ধা করার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারে নবীন, প্রবীণ সবাই একসঙ্গে মিলে মিশে থাকার বাঙালি সমাজ জীবনের চিরন্তন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে। দেশের বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে পরিবারের বাইরে রেখে, তাদের অবহেলা করে কখনো সুখী সংসার বা সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়।