ধ্বংসের মুখে চিংড়ি শিল্প

পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা জরুরি

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চিংড়ি এক সময় দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে পরিগণিত হতো। অর্থকরী ফসলের গুরুত্ব থেকে পাটকে যেমন বলা হতো সোনালি আঁশ, তেমনি চিংড়িকে নাম দেয়া হয়েছিল সাদা সোনা। কালের পরিক্রমায় দুটি পণ্যই গুরুত্ব হারিয়েছে। চিংড়িকে নিয়ে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, পরিস্থিতি বিবেচনায় তা এখন অকল্পনীয়। শুরুতেই পরিবেশ দূষণের নিয়ামক হিসেবে চিংড়ি শিল্পকে দায়ী করা হয়েছিল। নিয়তির পরিহাস, এখন পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় চিংড়ি চাষই দুরূহ হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি বিদেশে মৎস্য খাদ্যপ্রিয় ভোজন রসিক ক্রেতাদের জন্য প্রিয় নাম। বিদেশের বাজারে এই মৎস্য খাদ্য বাংলাদেশের পরিচয় বহন করছে কয়েক দশক ধরে। বিদেশের বাজারে ক্রমান্বয়ে এই খাদ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি চিংড়ি রপ্তানি করে আয় করছে উল্লেখযোগ্য মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাও। মূলত চাষিদের অক্লান্ত চেষ্টায় চিংড়ি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস এবং দেশে মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন পরিবেশ বিপর্যয় ও উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন হ্রাস এবং চাষের খরচ বৃদ্ধির তুলনায় দাম কম হওয়ায় চিংড়ি চাষ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া প্রান্তিক চাষিরা অবহেলারও শিকার। সে সব কারণে অনেকে চিংড়ি চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে কমছে চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ এবং উৎপাদন। রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

তথ্য অনুযায়ী, চিংড়ি চাষের শুরুতে ঘেরের মুখ খুলে দিলে নদী বা খাল থেকে লবণাক্ত পানির সঙ্গে চিংড়ির পোনা ঢুকে যেত। প্রাকৃতিক খাবার খেয়েই সেগুলো বড় হতো। পরে চাষের বিস্তৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তনে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা কিনতে হচ্ছে। কৃত্রিম ফিড দিতে হচ্ছে। এখন আবহাওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তনে নদ-নদীর নাব্য কমছে। জোয়ারের স্বাভাবিক গতি নেই। পানিতে লবণের মাত্রা ও উষ্ণতা বাড়ছে। ফলে চিংড়ির মৃত্যুহার বেড়েছে। বেড়েছে রোগবালাই। প্রকৃতির স্বাভাবিক পরিবর্তনের নিয়মে চিংড়ি ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়ায় পানির উষ্ণতা তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে চিংড়ি মেরে ফেলছে। এ ছাড়া জমির হারি, ফিড, পোনার দাম ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, অক্সিজেনের ব্যবহার এবং শ্রমিকের মজুরিসহ অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। অথচ চিংড়ির দাম সে হারে বাড়েনি। স্মর্তব্য, ৬০-এর দশকে দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। পরে এটি শিল্প হয়ে ওঠে। ৮০-র দশক থেকে বাগদা চিংড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি শুরু হয়। এখন আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রভাবে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে। চাষের ব্যাপ্তিও হ্রাস পেয়েছে। দেশে ২০১৪-২০১৫ বছরে ২ লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদার চাষ হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা চাষের জমির পরিমাণ হয় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৮ হেক্টর। চার বছরে কমে ৩১ হাজার ১৬০ হেক্টর। এ বিষয়ে সর্বশেষ পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে প্রতি বছরই চাষের জমি কমে যাচ্ছে বলে চাষিরা জানান। এক হিসাবে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে দেশে চিংড়ির উৎপাদন ছিল ৭৫ হাজার ১৬৭ মেট্রিক টন। এটা বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০১২-১৩ সালে উৎপাদন বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার ২৬১ টন। এর পর থেকে উৎপাদন ও রপ্তানি কমতে শুরু করে। বর্তমানে অবস্থা এমন যে, এই শিল্পটি এখন ধ্বংসের মুখে।

চিংড়ি শিল্প শুধু অর্থকরী ফসল নয়, এখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মরত রয়েছে। চিংড়িকে ঘিরে উপকূলের অনেক এলাকার জনজীবন পরিচালিত হচ্ছে। সুতরাং এই শিল্পকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সেই ব্যবস্থা করা দরকার। বলা হচ্ছে, জাতীয় অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের প্রকৃতিগত উন্নাসিকতায় এখন এই চিংড়ি সেক্টর ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সংগত কারণেই এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সরকারকে এখানে প্রণোদনার সঙ্গে কারিগরি সহায়তাও প্রদান করতে হবে। এই নিয়ে টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে- এটাই প্রত্যাশা।