আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সূচনাকালে এই ভাবনার পরিধি বেড়েই চলেছে। নতুন নতুন চিন্তাকেন্দ্রিক স্বপ্নের দ্বার উন্মোচনে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে প্রতিযোগিরা রাজনীতির অংক মেলাতে গলদঘর্ম হয়ে উঠেছে। কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রত্যাশা নিয়ে জোটবদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুতে। কিন্তু মূল লক্ষ্য সবারই এক ও অভিন্ন তা হচ্ছে নিজ নিজ দেশের উন্নতি সাধন। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি বর্তমান সভ্যতায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনীতির কৌশলও বদলাতে হচ্ছে। বিগত ২০২০-২১ মানুষ এক অজানা-অচেনা শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। অচেনা শক্তিটির নাম হচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনাকালীন বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল। ভঙ্গুর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে যে যার যার মতো করে চেষ্টা করেছে কেউ সফল হয়েছে, কেউ কেউ ব্যর্থ হয়েছে। কোনো কোনো দেশ দেউলিয়াত্ব বরণ করতেও বাধ্য হয়েছে। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গোটা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। উচ্চ আয় তথা উন্নত দেশগুলোও মহাসংকটে পড়েছে। সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি গ্রহণ করেছে বিভিন্ন দেশ। এমনি পরিস্থিতিতে নানান রকম জোট গঠিত হচ্ছে। এককভাবে কোনো দেশের পক্ষেই চলা সম্ভব হচ্ছে না। পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক মেলবন্ধনের লক্ষ্যে গঠিত জোট নবতর অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে একথা ঠিক যে, অর্থনৈতিক জোটের সাম্প্রতিক ভাবনার আগেও অনেক জোট গঠিত হয়েছে। এর একটি জোট হচ্ছে ব্রিক্স। ২০০৯ সালে চারটি দেশ নিয়ে প্রথমে ব্রিক গঠিত হয়, পরবর্তী বছর দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটে যোগ দেয়াতে নতুন নামকরণ হয় ব্রিক্স। ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট হচ্ছে ব্রিক্স। এই পাঁচটি দেশের নামের আদ্যাক্ষারে গঠিত ‘ব্রিক্স, নিয়ন্ত্রিত একটি নিউ ডেভলপমেন্ট (এনডিবি) ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে ২০১৫ সালে। ২০২১ সালে নতুন এই ব্যাংকের সদস্য হয়েছে আমাদের বাংলাদেশ। এখন মূল সংগঠন ব্রিক্স-এর সদস্য হওয়ার আবেদন করেছে। আগামী সম্মেলনে হয়তো এ আবেদন গৃহীত হবে। এমন প্রত্যাশা রয়েছে বাংলাদেশের। এ ছাড়াও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো ২ থেকে ১টি দেশ ব্রিক্স-এর সদস্য হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। এরা যুক্ত হলে ব্রিক্স-এর নামেরও পরিবর্তন আসবে। দেশের আদ্যাক্ষর সম্বলিত নামের ব্রিক্স নিঃসন্দেহে আরো বড় কোনো নাম হবে। হয়তো নতুন অন্য কোনো নাম ধারণ করবে। ব্রিক্স ছাড়াও বিশ্বে আরো অনেক জোট রয়েছে। জোটভিত্তিক চিন্তাধারার আদি ফসল হিসেবে জাতিসংঘ বা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রিত অনেকগুলো সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। এর বাইরেও অনেক নতুন নতুন জোট গঠিত হয়েছে বিশ্বে। যেমন- জি-৭, ডি-৮, জি-২০ ইত্যাদি। আবার ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্গত ছিল এমন দেশগুলোকে নিয়ে কমনওয়েলথ গঠিত হয়েছে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম), ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর জোট OIC, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে গঠিত সার্ক। (সার্ক এখন অকেজো)। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন EU, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা WTO, বিমস্টেক, ইত্যাদি। এসব জোট গঠনের পেছনে ইতিহাস আছে। আমি সে ইতিহাসে যেতে চাই না। বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আই.এম.এফ এসব অর্থনৈতিক জোটের ধারণা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে রকম একটি জোট ব্রিক্স-এর নিয়ন্ত্রণে নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনও তেমনভাবে সারা ফেলতে পারেনি। তবে ব্রিক্স জোটভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্বের ৪২ শতাংশ মানুষের বসবাস। অদূর ভবিষ্যতে এই ৪২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, যদি আরো দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। এটি একটি নতুন অর্থনৈতিক জোট। এর মূল লক্ষ্য পরস্পর দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো। অর্থনৈতিক সংকটকালে যেন একে অপরের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, সে রকম ভাবনা থেকে ব্রিক্সের নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে বড় ফ্যাক্টর। ডলারনির্ভর বাণিজ্য অনেক সময় অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যায়। এ অস্থিরতা দূরীকরণে নিউ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করতে পারে। ইউএস ডলার, পাউন্ড এবং ইউরো আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে ইউএস ডলার। সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্র ডলার সংকটের সৃষ্টি করে ডলারের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার নতুন চিন্তার উদয় হয়েছে।
ব্রিক্সের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জায়গায় শক্ত অবস্থান তৈরি হবে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার দৃষ্টিভঙ্গিতেই ব্রিক্স এগিয়ে যাচ্ছে। ব্রিক্স বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় এটা কতটুকু সফল হবে তা নির্ভর করবে শক্তি ও সামর্থ্যরে ওপর। শক্তি সামর্থ্য অর্জনেও কিছু জটিলতা রয়েছে- সেটি হচ্ছে, কৌশলগত ভূরাজনীতি। চীন-ভারতের সঙ্গে একটা বৈরিতা রয়েছে ভূরাজনীতিকে কেন্দ্র করে। এশিয়ার বৃহৎ শক্তির দেশ দুটো যদি রাজনৈতিক ঐক্যে ফিরতে না পারে, তবে ব্রিক্সের স্বপ্ন পূরণে বিলম্ব হবে। চীন-ভারতের রাজনৈতিক মেরুকরণে যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়, সেটা ব্রিক্সের গতিপথে কিছুটা হলেও বাধার সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পতিত রাশিয়া ব্রিক্সের শক্তি সামর্থ্যে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ব্রিক্সের নতুন অর্থনীতি বিকাশে বাংলাদেশ অনুপ্রাণিত হয়ে যোগ দেয়াটা ইতিবাচক হলেও কিছু জটিল সমীকরণ লক্ষণীয়। ভারত, চীন ও ব্রাজিল আমাদের আমদানির উৎস দেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রপ্তানির বাজার। বড় অংকের রেমিট্যান্স আসে পাশ্চাত্য থেকে। ইউরোপ-আমেরিকা আমাদের বিশেষ সুবিধার বাজার। পোশাক শিল্প আমরা রপ্তানি করি এসব দেশেই। ব্রিক্সের সদস্যপদ লাভ করে আমরা কী অর্জন করতে পারব, সেটিও ভাবনার বিষয়। আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীতে অধিকাংশ অর্থনৈতিক জোটই সভা, সমাবেশ ও আড়ম্বরপূর্ণ সম্মেলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শুধু জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ হয়। শুধু ব্যতিক্রম জি-৭ ও জি-২০ এ দুটো জোট যথেষ্ট কার্যকর, এরা জনগণের কল্যাণে কাজ করছে। কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের সংগঠন সার্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ সার্কভুক্ত জনগণের কোটি কোটি টাকা এতে ব্যয় করা হয়েছে।
যাই হোক, ব্রিক্স-এ যোগ দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এককভাবে কারো ওপর যেন নির্ভরশীল থাকতে না হয়। সে জন্য ব্রিক্সে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যেন আমাদের অর্থ বিনিময়ের সুযোগটা থাকে। আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যেন আমরা সহজে ক্রয় করতে পারি, আমার দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব করতে পারি। এসব বিবেচনা করেই কিন্তু আমরা ব্রিক্সে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিক্সে যোগ দেয়ার যৌক্তিক ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে বলা হয়েছে ব্রিক্স নিয়ন্ত্রিত এনডিবি, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প অর্থনৈতিক শক্তি হতে পারে। অর্থ সংকটকালে আমরা বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হই। যদিও এ দুটো সংস্থারও সদস্য দেশ বাংলাদেশ। তারপরও এ দুটোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প পথ খুঁজতেই এনডিবির সদস্য হওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোভিড অতিমারি বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছে। পতন ঘটেছে বিশ্ব অহংকারী দেশগুলোর। বিশ্বে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। করোনা নিয়ন্ত্রণে টিকা আবিষ্কার ও এর প্রাপ্যতা নিয়েও ছিল নানা জটিলতা। এমনি পরিস্থিতিতে নতুন উপলব্ধির জন্ম হয়েছে। বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেখা যাচ্ছে তারা বিকল্প মুদ্রা খুঁজছে। বিকল্প বাণিজ্যিক ব্যবস্থার দিকে এগুতে চাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ব ব্যবস্থা বদলে গেছে। বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হচ্ছে সবাইকে। বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগ দেয়ার প্রেরণা তৈরি হয়েছে, একটা বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অভিসিক্ত, ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে হবে। তাই অর্থনৈতিক মেরুকরণেও আনতে হবে পরিবর্তন। বহুপক্ষীয় জোটভুক্ত হয়ে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখাই হচ্ছে মুখ্য কাজ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আছে, কারো সঙ্গেই বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। অনেকেই মনে করছেন ব্রিক্সে যোগ দেয়া যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। হ্যাঁ? এটা ঠিক যে, যে কোনো সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। কোনো দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালীকরণে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি হয়ে পড়ে। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই দেশকে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলোতেও আমরা আমাদের বিভিন্ন পণ্যের বাজার তৈরি করতে পারি। সততা ও দক্ষতার সমন্বয়ে উৎপাদিত পণ্য সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। ব্রিক্সের সদস্য দেশগুলো পারস্পরিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য সহযোগিতায় ভূমিকা রাখবে। ব্রিক্স একটি শক্তিশালী সংগঠন হয়ে উঠুক। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর মতো এনডিবিও শক্তি ও সামর্থ্যবান হোক। পৃথিবীর মানুষ এদের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাটা প্রত্যক্ষ করুক।