সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইতিহাস ও প্রভাব

আলী ওসমান শেফায়েত, লেখক ও গবেষক

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কি?

সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো- culture যা ল্যাটিন পড়ষবৎব থেকে এসেছে। যা অর্থ কৃষিকাজ বা চাষাবাদ। সংস্কৃতি শব্দটি সংস্কার থেকে এসেছে, যার অর্থ কোনো জিনিসের দোষত্রুটি, ময়লা-আবর্জনা দূর করে তাকে ঠিকঠাক করে পরিশুদ্ধ করা। মানুষের চিন্তাচেতনা, আচার-আচরণ, জীবনযাত্রা, পোশাক, ভাষা, সাহিত্য, মূল্যবোধ, নৈতিকশিক্ষা, খাদ্যাভ্যাস, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি সবই তার সংস্কৃতি। মানুষ তা ধারণ ও চর্চা করে তাই তা সংস্কৃতি। বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি থাকে। দেশভেদ সময়ভেদে সংস্কৃতির পার্থক্য ঘটে। অন্যদিকে আগ্রাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো- ধমমৎবংংরড়হ যার অর্থ বিনা উস্কানি ছাড়া আক্রমণ। কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া অথবা কর্তৃত্বভাবাপন্ন বা অন্যায়ভাবে কোনো কিছু গ্রাস বা দখল করাকে আগ্রাসন বলে। সুতরাং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে বোঝায় কোনো সংস্কৃতিকে জোর করে গ্রাস, নিয়ন্ত্রণ বা ধ্বংস করা। কোনো একটি দেশের একক সংস্কৃতি যখন অন্যান্য দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং অন্য সংস্কৃতির স্থান যখন সেই সংস্কৃতি দখল করে নেয়, তখন আমরা একে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে পারি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে বলা হয় সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিহাস

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনটা হঠাৎ করে আসেনি। এ ধরনটা আসে পুঁজিবাদের ধারণা থেকে। সমান্তবাদী সমাজ থেকে যখন মানুষ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রবেশ করে, তখন পুঁজিবাদীরা চিন্তা করল- পুঁজির বিকাশ হবে না যদি তাদের সংস্কৃতিকে সবাই অনুসরণ না করে। কারণ তাদের মতো করে চিন্তা করতে হবে, তাদের মতো ভোগবাদী হতে হতে। বিভিন্ন উৎসবকে পণ্যের উৎসব বানাতে হবে, বাজার বৃদ্ধির জন্য সব কিছুকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে তার চর্চা করাতে হবে। মূলত পণ্যের ক্রেতা বৃদ্ধি করার জন্যই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনটা শুরু হয়। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জন্য গণমাধ্যম বিশেষ করে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ফ্যাশন, সাহিত্য, বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সংগীতকে তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আর এসব মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা তথ্যপ্রযুক্তি ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বিস্তারের নামে নানান ধরনের তাদেরই তাঁবেদারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে ব্যবহার করেছে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণ কি?

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অজন করা। তবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করাও আরেকটি কারণ। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দ্বারা নব্য উপনিবেশ স্থাপন করা। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দ্বারা সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখাও এর বড় কারণ। কারণ সবাই তাদের মতো চিন্তা করলে, আচারণ করলে, ভোগবাদী হলে, সাম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখা সহজ হবে। আর একটি দেশকে অর্থনীতি ও রাজনীতির দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করা যায় না। সংস্কৃতি দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করা যায়। অনেক সময় প্রভাবিত করতে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয় না। কারণ তাদের দেশীয় প্রতিনিধিরা তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে। দেশের মানুষ বেশি বেশি করে তাদের বিদেশি সংস্কৃতিকে চর্চা করে তাদের মতো হতে চায়; এটাকেই সভ্যতা, আধুনিকতা মনে করে। নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, রীতিনীতি আর ভালো লাগে না। বাংলাদেশে জন্ম; বেড়ে ওঠা, মায়ের ভাষা বাংলা, জাতি হিসেবে বাঙালি তারপরও তারা দেশকে ভালোবাসতে পারে না, ভালোবাসে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে। মানুষের চিন্তা-চেতনা, আদর্শকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হয়।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব

যে কোনো আগ্রাসনই হোক তার প্রভাব কখনই ভালো নয়। আর তা যদি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয়, তবে তা হয় আরো ভয়াবহ। কারণ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনটা বারবার প্রয়োগ করতে হয় না। একবার কোনো সমাজ বা দেশকে সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত করতে পারলেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন সহজ হয়। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন খুবই কঠিন ও সূক্ষ্ম বিষয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই মূলত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হয়। আর এধরনের আগ্রাসন মোকবিলা করতে যে সচেতনতা ও শিক্ষা দরকার এসব তাদের থাকে না। ফলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে এসব দেশগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর সংস্কৃতি সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকায় এসব দেশের রাজনীতি অর্থনীতি ও সামাজিক সব ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনটা সাবভৌমত্বের জন্য হুমকি। তারা রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে। দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত নিতে তারা সরকারকে বাধ্য করে। আর সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন দেওয়ার জন্য তাদের তৈরি দেশীয় একটি শ্রেণি আছে। তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করতে দ্বিধা করে না। আর এসব সংস্কৃতি তারা শিখেছে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সমাজে বিভক্তি তৈরি করে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে পুঁজিবাদীরা শিক্ষাকে ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত করে। তারা সমাজে কয়েক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে আর তার মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত করে দেয়। সংস্কৃতির আদান-প্রদানের নামে, তারা শিক্ষার মানোন্নয়নের নামে তাদের মনের মতো করে গোলাম তৈরি করছে। তাদের মনস্ক মানুষ তৈরি করার জন্য ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে। শুধু তাই নয়, তাদের তাদের সংস্কৃতিনির্ভর করে গড়ে তোলা যায় এমন শিক্ষা দেয়। এতে একদিকে ভালো ব্যবসা করা গেল, অপরদিকে তাদের সংস্কৃতির ব্যক্তি তৈরি করা গেল।

আজকে যদি জাতীয় স্বার্থে বা গণতন্ত্রে কোনো আন্দোলনের কথা বলা হয়, পশ্চিমা মনস্ক এসব শিক্ষার্থীদের পাওয়া যাবে না। আবার যদি বিদেশে শিক্ষা লাভের জন্য কোনো সেমিনারের কথা বললে এসব শিক্ষার্থীদের অভাব হয় না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হওয়া প্রতিটি দেশেরই একই অবস্থা। আমাদের ভাবা দরকার কেন এমন হলো? এর উত্তর হলো বিদেশি সংস্কৃতি প্রীতি মানুষকে ওই পর্যায়ে নিয়ে গেছে তারা বিদেশি সব কিছুকে ভালো, শ্রেষ্ঠ ও মানসম্মত বলে মনে করে। দেশের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী চিন্তা করে। এসব মিডিয়ার সাহায্যে তারা মানুষের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে দেশের মধ্যে দেশপ্রেমিক তৈরি না হয়ে দেশদ্রোহী তৈরি হয়েছে, যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য দেশের ক্ষতি করতে দ্বিধা করে না। দেশের প্রতি তাদের কোনো ভালোবাসা নেই, দেশের জন্য তাদের চিন্তাভাবনা নেই। বিদেশি রাষ্ট্রকে ভালোবাসে তার সাহিত্য, ভাষা থেকে শুরু করে খাদ্যাভাব, পোশাক, রীতিনীতি, প্রথা, নৈতিকতা, মূলবোধ বলতে গেলে সব কিছুকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে দেশীয় সাহিত্য, ভাষা, রীতিনীতি, প্রথা, পোশাককে বাদ দিয়ে।

এখন আমাদের শিশুরা ভারতের কার্টুন ডোরেমন দেখেই হিন্দি ভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা জন্মে যায়। ভারতের টিভি সিরিয়ালের রাশি রাশি নাটকে দেখানো পাখি ড্রেস দেখে আমরা ফ্যাশন পছন্দ করি। আমরা ক্যাটরিনা ড্রেসের কথা জানি, আমরা ধুম-২ প্যান্টের কথা জানি। কোনো সংস্কৃতির প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। এভাবেই বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নেতিবাচক হামলার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আজকে মাতৃভাষার প্রতি মানুষের কোনো মমতা নেই, শ্রদ্ধা নেই, নেই কোনো আগ্রহ। বিশ্বে এখন ইংরেজি ভাষার আগ্রসন চলছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখন সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ডে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজি ভাষার কারণে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সহজ হয়েছে। আর এর মাধ্যমে মানুষকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়। ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন শুধু উন্নয়নশীল দেশের জন্য নয়, অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার ভাষা আজ ইংরেজির দাপটে বিলুপ্ত হতে চলছে। ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনের শিকার ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোও। দক্ষিণ আমেরিকায় ইংরেজি ভাষার প্রভাব বাড়ছে। আর এশিয়া ও আফ্রিকায় ইংরেজি ভাষার একক আধিপত্য।

সহিংসতাকে মিডিয়া ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেখিয়ে অস্ত্র ব্যবসাকে জমজমাট করছে। তারা যুদ্ধ ও অ্যাকশন মুভি দেখিয়ে মূলত অস্ত্রের প্রচার বা বিজ্ঞাপন দেয়। মদের বিক্রি বাড়াতে তারা মুভিকে বেছে নেয়, মুভির সাহায্যে মদের বাজার বৃদ্ধি করা হয়। সারা বিশ্বে মদের বাজার বৃদ্ধিতে মুভির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যৌনতাকে পণ্য হিসেবে মুভিতে বা বিভিন্ন সাহিত্যে দেখানো হয়। যৌন বাণিজ্যকেও সারা বিশ্বে সংস্কৃতির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃতির আদান-প্রদানের নামে চলে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন।

আজ বিভিন্ন কনসার্টের উদ্ভাবন হচ্ছে তাদের হাত ধরে। বিভিন্ন দিবসের প্রচলন ঘটিয়েছে তাদের পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য। ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস তারা চালু করেছে। এগুলোর নাম শুনে খুশি হওয়ার কারণ নেই। কারণ এসব দিসবের উদ্দেশ্য পণ্যের বিক্রি বাড়ানো। সংস্কৃতির আদান-প্রদানের নামে মানব আমদানি করা হয়। দুই ধরনের মানুষ তারা আমদানি করে- ১. সর্বোচ্চ মেধাবী ও ২. শ্রমিক শ্রেণি। তারা সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা নেয় আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন করে অন্য দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে তারা সুবিধা অর্জন করে।

পরিশেষে বলা যায়, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বর্তমান সময়ে উন্নত দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির সমৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের জন্য শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। তবে সে সমস্যার শিকার হচ্ছে- গরিব দেশগুলোই। গরিব দেশগুলোর পক্ষে থেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলা করার কথা বলা হয় আর ধনী দেশগুলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নামে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য একে ব্যবহার করে। এভাবেই গরিব ও ধনী উভয় দেশগুলোর জন্যই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।