অর্থনীতি

নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি কি সহনীয় পর্যায়ে আসবে?

মো. মাঈনউদ্দীন, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, [email protected]

প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর মধ্যে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ ডলারের বিনিময় হারের চাপ। তাছাড়া রিজার্ভের পতন, লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট। এই চ্যালেঞ্জগুলো মানুষের জীবনমান বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনমানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে চলেছে, জ¦ালনি তেলের দাম বেড়ে গেছে, টাকা দাম কমে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। মুদ্রানীতিতে নীতিসুদ হরের করিডর প্রথা, সুদ হারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের একক দাম, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য তা আই. এম. এফ. এর বেঁধে দেওয়া ঋণ শর্তের মধ্যেও ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানিয়েছেন মুদ্রানীতির কাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটের ঘোষিত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ নামিয়ে এনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ঘোষিত মুদ্রনীতিটি সংকোচনমূলক। মুদ্রানীতিতে সুদহারের সীমা তুলে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে বলা হয় ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যুক্ত করতে পারবে।

এটাই হলো সুদের সর্বোচ্চ হার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ মাসে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলে গড় সুদছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ। সে হিসাবে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ১০ দশমিক ১২ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (সি. এম. এস. এম. ই.) ও ভোক্তা ঋণের তদারকি খরচের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো ১ শতাংশ বেশী আরোপ করতে পারবে। ক্রেডিট কার্ডের সুদহার আগের মতোই ২০ শতাংশ থাকছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থনীতির একটি সাধারণ পলিসির হলো মুদ্রা সরবরাহ কমালে সুদের হার বাড়ালে ইমপ্রেশন কমে আসে। বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে এলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করেছে অর্থাৎ বাজারে টাকার সরবরাহ কমানো এবং সুদের হার বাজারে আংশিক ছেড়ে দিয়েছে। এটা একটা ভালো দিক। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটটা বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। সুদের হার ট্রেজারি বিলের রিটার্নের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। সুদের হার কতটা কার্যকর হয় তা দেখার বিষয়। কারণ বাংলাদেশের জনগণ এখনও ৪০ শতাংশ ব্যাংক খাতের বাইরে রয়েছে। এখনও মহাজনি প্রথা গ্রাম এলাকায় বলবৎ দেখা যায়। মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো হার ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এতে রেপো হার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠবে। আর রিভার্স রেপো হার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়। ফরেন এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রে শুধু রেটটা ঠিক করলে রেমিটেন্সের বিষয়ে কিছু করার কথা বলা হয়নি। অথচ দেশের জনশক্তির একটা অংশ সারা বিশে^র বিভিন্ন আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈধ চ্যানেলে এলে রেমিট্যান্স অনেক বেড়ে যায়। প্রবাসীদের অর্থটা কীভাবে দ্রুত কালেক্ট করে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনা যায় সে বিষয়ে নির্দেশনা থাকা উচিত। এক্ষেত্রে হুন্ডির লোকেরা সহজে অর্থ সংগ্রহ করে মোবাইলে মেসেজ করে হুট করে টাকা পাঠিয়ে দেয়। প্রবাসীদের দ্বারে দ্বারে ব্যাংক চ্যানেল না গেলে হুন্ডির ব্যাপকতা কমানো যাবে না। তাই রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। ব্যাংক খাতের রেমিটেন্স পলিসি চেঞ্জ করে প্রবাসিদের দোড় গোড়ায় যেতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। আর.এম.জি. সেক্টরের ওপর ভর করে আর গুটি কয়েক রপ্তানি পণ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত হারে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ সম্ভব হবে না। তাই দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সহজে ও দ্রুত ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিটেন্স সংগ্রহের ব্যাবস্থা করা উচিত। আরেকটা বিষয় হলো ব্যাংকিং খাত সংস্কার করতে হবে। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরে না এলে মুদ্রানীতির ফল পাওয়া কঠিন হবে। ব্যাংক খাতে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বজনপ্রীতি দুর করতে হবে। খেলাপি ঋণ দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তা ব্যাংক খাতের জন্য অসনিসংকেত। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণসহ সব খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোরনীতি প্রণয়ন করা উচিত। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত হারে ঋণ আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সার্কুলার দিয়ে খেলাপি আদায়ের জন্য সুযোগ দিলেও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি গ্রাহকরা তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ গ্রহণ করে সময় মতো ও নিয়মিত ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসছে না। ফলে খেলাপির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে। কেন্দীয়ও ব্যাংকের মতে আমাদের মূল্যস্ফীতি মূলত সরবরাহজনিত। বিশেষ করে আমদানি খরচ বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলব, তাহলে আমাদের উচিত উৎপাদন বাড়ানো। সরবরাহ বাড়াতে হলে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনশীল খাতে ঋণ বাড়ানো উচিৎত এ খাত দুর্বল হলে কর্মসংস্থানও কমে যাবে। সি. এম. এস. এম. ই. খাতে ঋণ বাড়ালে কর্মসংস্থান বাড়বে ইনকাম জেনারেট হবে, ভ্যালু এডিশন হবে। ফলে পণ্য সরবরাহ বাড়বে। কিন্তু মুদ্রানীতি তা দেখা যায় না। কারণ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে সব সময় ছোট ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাংক ও আর্থিক খাত এদের ঋণ দিতে চায় না। অথচ এই খাতে ঋণ আদায়ের হারও বেশি। বিরাট জনশক্তি এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিল্প খাত দুর্বল হলে বেকারত্বও বাড়তে থাকবে।

তাই আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো সাপেক্ষে যেসব নীতি কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে তা সামঞ্জস্যপূণ নয়। আমাদের মুদ্রানীতি হলো সংকোচনমূলক, বাজেট হলো সম্প্রসারণমূলক। বাজেটে ব্যয় করবে বেশি অর্থ আর মুদ্রানীতি সংকোচন করা হবে মুদ্রা সরবরাহ। এতে বেসরকারি খাত আক্রান্ত হবে। এখন রিজার্ভের বিষয় দেখলে দেখা যায় আমাদের রিজার্ভ কমছে। রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যতটুকু বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হচ্ছে তা আবার বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি ব্যয় পরিশোধে কমে যাচ্ছে। রপ্তানিও তেমন হচ্ছে না। এদিকে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের দিকে দেখলে দেখা যায় এখানে যে দুটো কম্পোনেন্ট আছে যথা কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্স যেখানে মূলত রপ্তানি, আমদানি ও রেমিটেন্সের প্রতিফলন হয় আর দ্বিতীয়টি হলো ক্যাপিট্যাল অ্যাকাউন্ট। যেখানে থাকে ক্যাপিট্যাল অ্যাসেটে ট্রান্সপার, মূলধনি হিসাব, বাংলাদেশ ব্যাংকের আয় হিসাব। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট। এটা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে দেখানো হয়। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ দেখা দিলে রিজার্ভ বাড়ানো কঠিন। এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এজন্য আমাদের রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। রপ্তনি আয় বাড়াতে হবে। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের বেশি আসা না করে রেমিট্যান্স বাড়ানো প্রতি মনোযোগী হতে হবে। কারণ এফডিআই হঠাৎ করে আসবে না।

আমাদের এটা এক বিলিয়ন ডলারও আসে না। অথচ ভিয়েতনামে প্রায় ছয় বিলিয়নের মতো আসে। আমাদের কৃষি হলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী খাত। আমরা যদি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতে পারি, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে বিরাট সুযোগ তৈরি হবে। পত্রিকার রিপোর্ট ও এফ এ ও এর তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে চাল, মসুর ডাল, আলু, পেঁয়াজ, চায়ের মতো পণ্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ফল। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৪তম দেশ। তবে এফ. এ. ও.-এর হিসাবে দেখা যায়, প্রাথমিক হিসাবে কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম।

বৈদেশিক আহরণের জন্য কৃষির এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগতে হবে। মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক, বাজেট হলো সম্প্রসারণমূলক, তথাপিও মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বাজার মনিটরিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। যদিও এটি মুদ্রানীতির বাইরে। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগী, সিন্ডিকেট ও দালালদের প্রাধান্য বেশি লক্ষণীয়। কিছু কিছু ব্যবসায়ী পণ্য গুদামজাত কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। সরবরাহ সংকট তৈরি করে ও পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং জোরদার করা উচিত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না হলে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।