ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জলাবদ্ধতায় জনগণেরও দায় রয়েছে

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
জলাবদ্ধতায় জনগণেরও দায় রয়েছে

এবারের আষাঢ়ে তেমন বৃষ্টি না হলেও শ্রাবণের শুরুতে প্রবল বর্ষণ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। ২৯ জুন ঈদুল আজহার দিনে শুরু হওয়া বৃষ্টি পরের দু’দিনও অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে এবং রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। কোরবানির পশু জবাই করতেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় রাজধানিবাসীকে। ২৪ ঘণ্টার ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ঢাকা মহানগরীর কোনো কোনো এলাকা জলমগ্ন জনপদে রূপ নেয়। কোথাও দেখা যায় হাঁটুপানি। ১ জুলাই অফিস কর্মদিবস শুরুর দিন ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ায় ৬ ঘণ্টার জলাবদ্ধতায় অফিসগামী ও অফিসফেরত মানুষকে পড়তে হয়েছে মহাসংকটে। রাজধানীর বিভিন্ন এলকায় ছিল যানবাহনের স্বল্পতা। বাণিজ্যিক এলাকার অনেক মানুষকে দোকানপাট বন্ধ রেখে ফিরতে হয়েছে বাড়িতে। বিগত বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতার চিত্র পর্যবেক্ষণে লক্ষ্য করা যায়, ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা তলিয়ে যায়। বৃষ্টির স্থায়িত্ব বেশি হলে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় দেখা দেয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। আর বর্ষণ মানেই রাজধানীবাসীর জন্য চরম দুর্যোগ, সীমাহীন বিড়ম্বনা। নিম্নমানের রাস্তার ওপর অল্প সময় পানি জমে থাকলে সড়ক কাঠামোর নড়বড়ে হয়ে যায়। সড়কের উপরিতলের বিটুমিন, খোয়া, ইট-সুরকি উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্ত তৈরি হয়। রাস্তা হয়ে পড়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। কর্মজীবী মানুষের নিত্য যাতায়াতের সঙ্গী রিকশা-স্কুটারের ভাড়া বেড়ে যায় দ্বিগুণ, তিন গুণ। বিভিন্ন সড়ক, ঘরবাড়ি, দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ে। সড়কে রিকশা, ভ্যান ডুবে গেলে চলতে শুরু করে নৌকা। গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে অচল হয়ে পড়ে। দেখা দেয় যানজট। ঢাকার আশপাশের নিম্নাঞ্চলে কোথাও কোথাও ভেসে যায় ফসলি জমি। টানা বর্ষণে রাজধানী ও আশেপাশের নিচু এলাকা তলিয়ে লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দশা। দিনমজুর, খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের রুটিরুজিতে টান পড়ে। শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়ে। দেখা দেয় খাবার পানির তীব্র সংকট। ঢাকার মতো রাজধানী শহরে এ ধরনের জলাবদ্ধতা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিগত বছরগুলোতে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতার চিত্র পর্যবেক্ষণে লক্ষ্য করা যায়, ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই শহরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা তলিয়ে যায়। ঢাকার মতো রাজধানী শহরে এ ধরনের জলাবদ্ধতা শুধু জনজীবনে ভোগান্তি সৃষ্টি করে না, যানজটে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাসের মহানগরী ঢাকায় খাল, নিচু জায়গাগুলো ভরাট করে পরিকল্পনাহীনভাবে বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের স্থাপনা, নগর অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন সড়কে উন্নয়ন কাজে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে ছোট-বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। এসব গর্তে পানি জমে সড়ক যানবাহন চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত ড্রেনেজ না রেখে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটবড় নালা-নর্দমা সারা বছর ধরে ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকায় বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরী অনেক এলাকা পানিতে ডুবে যায়। ঢাকা শহরে কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক উপযুক্ত ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাস্টবিন ও কনটেইনার, যা আছে তাও ডিডিসি কর্তৃপক্ষ নিয়মিত পরিষ্কার করতে সক্ষম নয় বলে ময়লা উপচে রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ড্রেনে গিয়ে পড়ে এবং ড্রেনে সিউয়েজ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। উপরন্তু ঢাকা অপেক্ষাকৃত কম ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেনের মধ্য দিয়ে বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকায় বর্জ্যমিশ্রিত বৃষ্টির পানি ড্রেন উপচিয়ে রাস্তাঘাট তলিয়ে দেয়। জলাবদ্ধ পানি পচে পরিবেশকে করে তোলে বিষময়, বাড়ে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব।

রাজধানীর জলাবদ্ধতার সংকট অনেক দিনের পুরোনো। অতীতে এই শহরে ৬৫টি খাল, ২ হাজার পুকুর এবং আড়াই হাজার ক্যাচপিট ছিল। এসব দিয়ে সহজে বৃষ্টির পানি রাজধানীর প্রশস্ত খালগুলোতে নিষ্কাশিত হতো। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা পানি নিষ্কাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কিন্তু বর্তমানে ঢাকার আশপাশের নদী, খাল-নালাসহ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট ও অবৈধ দখলদারের হাতে চলে যাওয়ায় আজ তা অস্তিত্বহীন। বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি খালের সঙ্গে আজ আর নদীর তেমন কোনো সংযোগ নেই। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তৈরি প্রয়োজনের চেয়ে সরু বক্স কালভার্টগুলো বৃষ্টির পানি অপসারণে তেমন কাজে আসে না। অনেক ক্ষেত্রে এসব কালভার্টে ডাবের খোসা ও পলিথিনের মতো অপচনশীল কঠিন বর্জ্য আটকে বৃষ্টির পানি নির্গমন পথ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর রাজধানীর পশ্চিমাংশে বিশাল বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এ বাঁধ দেওয়ার সময় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। অতীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এবারের ঈদুল আজহায় রাজধানীতে কমপক্ষে ৫ লাখ কোরবানি দেওয়া পশুর বর্জ্য অপসারণ রাজধানীর জলাবদ্ধতায় যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ঈদের দিন যত্রতত্র পশু কোরবানি দিয়ে পশুর পরিত্যক্ত নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলার কারণে বর্জ্য ড্রেনে পড়ে অটকে যায়। সিটি করপোরেশন জনগণের মাঝে ১১ লাখ পলিব্যাগ সরবরাহ করলেও তা বর্জ্য ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়নি। দুই সিটি করপোরেশন দুটি কসাইখানা নির্মাণ করলেও সেখানে পশু কোরবানি দিতে জনগণের অনীহা দেখা যায়। কোরবানির জন্য ১২৫টি স্পট ইতোপূর্বে নির্ধারণ করলেও তা ব্যবহারে উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

ঢাকাবাসীর নাগরিক সেবা দান একক কোনো সংস্থার অধীনে নয়। মহানগরীর জলাবদ্ধতার মতো প্রকট সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব অনেকগুলো অধিশাখার ওপর ন্যস্ত। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ওপর। ১৯৮৮ সালে তা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত হয়। ওই সময়ে রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার এবং প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ড্রেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াসা পালন করত। এর পর ৩৬০ কিলোমিটার পানি নিষ্কাশনের বড় নালাও তৈরি করে ওয়াসা।

এ সবের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষণার জন্য সংস্থাও রয়েছে। কিন্তু নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। খালগুলোকে দখলমুক্ত করার চেষ্টা করা হলে কিছু সুফলও মেলে। কিন্তু খালগুলো উদ্ধার ও অবর্জনামুক্ত করলেও তা বেশিদিন না টেকায় জলাবদ্ধতার সমস্যা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। এর বাইরে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে থাকা ১৭টি খাল ও জলাশয় আগামীতে সিটি করপোরেশনের হাতে দিলে কী সুফল আসে বলা যায় না। কেননা বিগত বছরগুলোতে বিপুল অর্থ ব্যয়ে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি। গত এক যুগে সব মিলিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও কোনো কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। রাজধানীতে বছরজুড়ে নানা উন্নয়নমূলক কাজে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলে। কখনো সিটি করপোরেশন, কখনো ওয়াসা, আবার কখনো অন্যান্য সেবামূলক সংস্থার উন্নয়ন কাজে রাস্তা খুঁড়ে জলাবদ্ধতাকে বাড়িয়ে তোলে। এসব সংস্থার মধ্যে কাজের সমন্বয় সাধন করেই জলাবদ্ধতার মতো একটি সমস্যার সমাধান করতে হবে।

আর তা না হলে হাজার হাজার কোটি টাকার নানা প্রকল্প গ্রহণের কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না। মহানগরীর হারিয়ে যাওয়া নদী ও খালগুলোকে দখলমুক্ত করে যথাযথ সংস্কার করা ছাড়া কখনোই জলাবদ্ধতা দূর করা যাবে না। আগামীতে নগরায়ণ প্রক্রিয়াকে একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি সহজে সরে যেতে না পারলে জলাবদ্ধতা ঠেকানো সম্ভব হবে না। এ ছাড়া বর্ষা মৌসুমের আগেই ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-নদী খনন, খালের তলদেশে জমাকৃত বর্জ্য অপসারণ করে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল রাখতে পারলে তা আগামীতে রাজধানীর জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতার জন্য দায় রয়েছে সব সেবাদানকারী সংস্থার। বর্ষা শুরুর আগেই খাল ও নর্দমাগুলো ওয়াসাকে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। আর সিটি করপোরেশনকেও রাস্তা মেরামতের সব কাজ বর্ষা শুরুর আগেই শেষ করতে হবে। বৃষ্টিপাতের সময় নগর উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কাজ জলাবদ্ধতাকে বাড়িয়ে তোলে। শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল অর্থ ব্যয় করলে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে না। বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার পথকে সব সময় উন্মুক্ত রাখতে হবে। উন্নয়ন কাজ করার পর তার রক্ষণাবেক্ষণ না হলে খাল ও ড্রেনের মুখ আবার বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। জলাবদ্ধতার সংকট নিরসনে জনগণেরও দায়দায়িত্ব রয়েছে অনেক। বর্জ্যকে সঠিক ফেলে অপসারণ ব্যবস্থাকে সচল রাখা জনগণের নাগরিক দায়িত্ব। একের দায় অন্যের ওপর না চাপিয়ে নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই হতে পারে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত