ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনীতি

আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই : এই মুহূর্তে যা করণীয়

সাদ্দাম হোসেন, সাংবাদিক ও লেখক
আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই : এই মুহূর্তে যা করণীয়

আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা তাদের ফায়দা লুটে ইতোমধ্যে হাওয়া হতে শুরু করেছে; আর যারা ত্যাগী নেতাকর্মী তাদের মূল্যায়ন না হওয়ায় অনেকে অভিমানে এখনও দূরে সরে আছে। দেখা দিয়েছে আওয়ামী রাজনীতিতে ত্যাগী কর্মী-সংকট ও অস্থিরতা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহাসিক সংগঠনটি এখন কঠিন এক সময় পার করছে। ক্ষমতা আর দল একাকার হয়ে যাওয়াতে লাভবান হয়েছে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া দলের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দলের সাংগঠনিক শক্তি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী রাজনীতিতে স্থবিরতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দল, প্রশাসন ও ক্ষমতা একাকার হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে ও জনগণকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বুঝতে পেরেছে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও পরিকল্পিত প্রচারের অভাবে সংগঠনের বেহাল অবস্থা। তাই এখন প্রতিটি সময়, প্রতিটি দিন আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর এক প্রাণপণ সংগ্রাম। তাই কোনো আবেগের সিদ্ধান্ত নয়, বাস্তবমুখী কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হবে। আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।

প্রথমত, আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী, বয়োজ্যেষ্ঠ ও মেধাবী নেতৃত্বকে সংস্কারপন্থি হিসেবে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে এটি বাস্তব সত্য। এসব নেতৃত্বকে দল ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আবারও কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং তাদের বিশ্বাস করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নেত্রী গ্রেপ্তার হলে অনেকে হয়তো সাহস করে দাঁড়াতে পারেননি; কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি তাঁদের আস্থা ও শ্রদ্ধা অপরিসীম এবং এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই।

দ্বিতীয়ত, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পারিবারিক বলয় থেকে আওয়ামী লীগকে বের করে এনে সারাদেশে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও সৎ নেতাকর্মীদের দলের নেতৃত্ব এবং নির্বাচনী প্রচার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের কারা মূলধারার ও ত্যাগী কর্মী এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কি পর্যায়ে রয়েছে তার একটা প্রকৃত চিত্র কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে সংগ্রহ করতে হবে। এজন্য মহানগর ও জেলায় আওয়ামী লীগের যে উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে তাদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বৈঠক করে কিভাবে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের গতিশীল এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দূর করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারে। কারণ, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মতবিনিময় সভায় প্রকৃত চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না।

তৃতীয়ত, মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে এবং তৃণমূল জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে ও ক্লিন ইমেজ আছে এমন নেতৃবৃন্দকে প্রাধান্য দিয়ে মনোনয়ন প্রদান করতে হবে। এজন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, মাঠ পর্যায়ে যারা বিভিন্ন জরিপ টিমে কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে তাঁর বিশ্বস্ত ও আইটি কাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে বিভিন্ন জরিপ রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে পারেন। রিপোর্টগুলো থেকে যেমন সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে তেমনি নির্বাচনী এলাকায় দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও তার সংকটেরও সুপারিশ পাওয়া যাবে, যা দলীয় সভানেত্রীর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়ক হবে। শুধু তাই নয়, জরিপ রিপোর্টে যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদের সবুজ সংকেত দিয়ে এখনই সর্বক্ষণিক মাঠে থাকার নির্দেশ দিতে পারেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

চতুর্থত, আওয়ামী লীগের প্রচার সেলকে আরও অনেক শক্তিশালী করতে হবে। প্রচার সেলে সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ ডিজিটাল লাইনে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এ সেল বিরোধী পক্ষের বিভিন্ন অপপ্রচারের জবাব দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেল বিভিন্ন ডকুমেন্টারি তৈরি করে সরকারের সাফল্য জণগণের সামনে তুলে ধরবে। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ব্যাপক পোস্টার ও ডিজিটাল প্রচারণা চালাতে হবে।

পঞ্চমত, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী প্রস্তুতি ও পরিচালনা সেলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ সেলে আওয়ামী লীগের ত্যাগী-অভিজ্ঞ নেতৃত্বের সঙ্গে বিভিন্ন পেশাজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আইনজীবী ও তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকাকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ঢাকার বাইরেও এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। যেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে ও সংকট সমাধানে ওই সময় বিভিন্ন অঞ্চলের ফিডব্যাক পেতে পারেন। শুধু তাই নয়, এই সেল আঞ্চলিক পর্যায়ের জরিপ টিমের সঙ্গে ওই অঞ্চলের স্থানীয় ইস্যুগুলো কাজে লাগিয়ে কী ধরনের নির্বাচনী কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে তার একটি ছক তৈরি করবে। কেন্দ্রীয় সেলের সহায়তায় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্থানীয় পর্যায়েও নির্বাচনী প্রস্তুতি ও পরিচালনা সেল গঠন করতে হবে।

ষষ্ঠত, দলের সাধারণ সম্পাদককে আরও সক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে সংগঠনের নেতাকর্মীদের বেশি সময় দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয়ভাবে টিম গঠন করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গ্রুপিং মিটিয়ে ফেলার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্বকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে জেলা-উপজেলাগুলোতে ঘনঘন সভা ও সমাবেশ করতে হবে।

সপ্তমত, নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য গ্রাম অঞ্চলে সমাবেশ করে ব্যাপক ডিজিটাল প্রচারণার মাধ্যমে নারীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। বিষয়গুলো প্রচারের জন্য বিভিন্ন নারী সংগঠনকে কাজে লাগাতে হবে।

অষ্টমত, আওয়ামী লীগের নেতা ও বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বক্তব্য পরিহার করে মার্জিত ও যুক্তিযুক্তভাবে বক্তব্য ও মন্তব্য প্রদান করতে হবে। যারা বিগত বছরগুলোতে নানাভাবে বিতর্কিত হয়েছেন তাদের মিডিয়ার সামনে না আসাই ভালো। কারণ অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মিডিয়ার সামনে অতিকথন আওয়ামী লীগের ভোট বাড়াতে সহায়ক হবে না, বরং ভোট কমাবে।

নবমত, আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন অঙ্গসহযোগী সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনকে সক্রিয় করতে হবে। এসব পেশাজীবী সংগঠনের অনেক নেতা ক্ষমতায় আসার পর বড় বড় পদ বাগিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন এবং সংগঠনগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের অভাবে মারাত্মক গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। পেশাজীবীদের গ্রুপিং আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে দল ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নামে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছে, এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠন বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় রাতারাতি তৈরি হয়ে গ্রুপিং ও দুর্নীতি বিস্তারে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এসব ভুঁইফোঁড় সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে।

দশমত, যারা আওয়ামী রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় আছেন, কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল চিন্তায় উজ্জীবিত, তাদের দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে বৃহত্তর ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। একাদশতম, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিকে জোটের সঙ্গে রাখতে হবে। বিগত বছরগুলোতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্তৃক জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের তেমন মূল্যায়ন না হওয়ায় তাদের মধ্যে নানাভাবে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সহায়তায় স্থানীয় পর্যায়ের এ ক্ষোভকে প্রশমিত করতে হবে এবং ঘন ঘন কর্মসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় পার্টিকে আস্থায় এনে মহাজোটকে শক্তিশালী করতে হবে। জাতীয় পার্টি এই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গেলে তা জোটের অবস্থানকে আরও নাজুক করে তুলবে।

দ্বাদশতম, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সখ্য বাড়াতে হবে। দল সরকারে আসার পর এসব গ্রুপ ও সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

তাছাড়া তরুণ-মেধাবী প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তার যথাযথ জবাব দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিডিয়া কর্মীদের কাছে বিভিন্ন প্রেস রিলিজসহ দলীয় কর্মকাণ্ডের খবরাখবর পৌঁছে দিতে হবে।

আমি অত্যন্ত আশাবাদী, উল্লেখিত পদক্ষেপ ও উদ্যোগগুলো আওয়ামী লীগ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে পারলে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে ইতিবাচক সাফল্য আসবে ও দলগতভাবে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, বাংলাদেশকে তার অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও ঘামে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে তাদের ভুলের কারণে আগামীতে যদি বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় নেমে আসে, এই বিপর্যয়ের খেসারত বাঙালি জাতিকে কতকাল যে বয়ে বেড়াতে হবে তা কেউ জানে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত