মানবজাতির বিলুপ্তিতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ভূমিকা

হাসান আলী, সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রবীণ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভাব হয়েছে। ১০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। তখন দীর্ঘায়ু হওয়াকে মানুষ সৌভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করত। ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, প্লেগ রোগে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। গ্রামকে গ্রাম মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। কার কখন মৃত্যু হবে বলা মুশকিল ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়ে গেছে

অচিরেই পৃথিবী মনুষ্যবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তিনি তাগিদ দিয়েছেন আগামী ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে অন্য কোনো গ্রহে মানুষের বসবাস গড়ে তুলতে। অন্যথায় মানবজাতির বিলুপ্তির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পারমাণবিক অস্ত্র পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ক্রমাগত সম্পদের কেন্দ্রীভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে বিত্তহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে আর বিত্তহীন মানুষ সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করে মানবজাতির বিনাশে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ব্যাপক কার্বন নিঃসরণে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটবে। তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বহু লোককে স্থানান্তর হতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম দ্রুত বর্ধনশীল প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে পৃথিবীর প্রধান পাঁচটি ঝুঁকির একটি হিসেবে বিবেচনা করছে। ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, পৃথিবী ভয়ংকর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আমার মতে, পৃথিবীর সামনে প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে যথা- সম্পদের অসম বণ্টন, নিয়ন্ত্রণ মানসিকতা এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠী। লড়াই-সংগ্রাম করে সম্পদের সুষম বণ্টন করা সম্ভব হতে পারে। জেগে ওঠা মানুষ সম্পদের ওপর কিছু মানুষের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে পারে। কিংবা মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে একদিন সবার সঙ্গে মিলেমিশে সম্পদ ভাগাভাগি করে ভোগ করবে। মানুষ যদি বুঝতে পারে সম্পদ শারীরিকভাবে ভোগ করার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি তবে হয়তো সম্পদ ভোগের দানবীয় নেশা থেকে মুক্ত হতে পারবে। সম্পদের অসম বণ্টন একটা সময়ে অবসান ঘটানো হয়তো সম্ভব হবে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারবে। মানুষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা জন্মগতভাবেই রয়েছে। সবকিছু নিজের অধিকারে দখলে নেয়ার তাড়না সহজাত প্রবৃত্তি। এই দখলে নেয়ার তাড়না তৈরি হয় নিরাপত্তাহীনতা থেকে। ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদগ্রীব মানুষ ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। মানুষ দখলকে কেন্দ্র করে মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে সভ্যতা, গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর ধ্বংস করেছে। যতদিন যাচ্ছে মানুষের মধ্যে দখল মানসিকতা কমে যাচ্ছে। একদিন ব্রিটিশরা প্রায় সারা দুনিয়ায় তাদের দখল জারি রেখেছিল। জাপান-ফ্রান্স বেশ কয়েকটি দেশকে নিজেদের দখলে রেখেছিল। যুদ্ধ আর রক্তপাতে দখল উচ্ছেদে বড় ভূমিকা পালন করে। দখল বজায় রাখা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে।

মানুষের মধ্যে ক্রমেই দখলবাজদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে। এখন দেশ দখলের চেয়ে বাজার দখলের চেষ্টা তীব্র। দেশ দখলে ঝামেলা বেশি, খরচ বেশি, ঝুঁকি বেশি- সে তুলনায় বাজার দখল তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ। বিনিয়োগের নামে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ন্ত্রণ দিন দিন আলগা হয়ে যাচ্ছে। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলো আস্তে আস্তে তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলেছে। বিদেশি সাহায্য-অনুদান, ঋণের জন্য কাতরতা তেমন একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার এরই মধ্যে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। দিন যত যাবে, সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার ততই কমতে থাকবে। উন্নত দেশের পুঁজি বিনিয়োগকারীরা নানা ধরনের সংস্থার মাধ্যমে নামমাত্র সুদে কিংবা স্বল্পসুদে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণ দেয়ার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। উন্নত দেশের পুঁজি স্থবির হয়ে পড়ছে। অস্ত্র এবং মাদক ব্যবসার মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছে।

সাজানো-পাতানো যুদ্ধ খেলা এবং জঙ্গিবাদ উসকে দিয়ে ‘নিয়ন্ত্রণ’ খেলা জমছে না। ধর্মে-বর্ণে এবং জাতিতে জাতিতে সংঘাত সৃষ্টি করে ‘নিয়ন্ত্রণ’ বজায় রাখার কৌশলটি ভবিষ্যতে তেমন কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা ধরে নিতে পারি, পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণ কৌশলটি অচিরে অকার্যকর হয়ে যাবে। সর্বশেষ থাকে প্রবীণ জনগোষ্ঠী। প্রবীণ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জরূপে আবির্ভাব হয়েছে। ১০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। তখন দীর্ঘায়ু হওয়াকে মানুষ সৌভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করত। ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, প্লেগ রোগে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। গ্রামকে গ্রাম মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। কার কখন মৃত্যু হবে বলা মুশকিল ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়ে গেছে।

মানুষ ধারণা করতে পারছে কতদিন বেঁচে থাকবে। অপঘাতে মৃত্যু না হলে একজন মানুষ ৮০ থেকে ৯০ বছর বেঁচে থাকতে পারবে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, মানুষ ১৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে। পৃথিবী একটা সময় সম্পদের সুষম বণ্টন করতে পারবে এবং নিয়ন্ত্রণের ভয়ানক আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হবে। আর যদি সুষম বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রণ প্রবণতা রোধ করা না যায় তবুও বর্তমান সময়ের মতো এমন তীব্রতা থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু কোনো মতেই বার্ধক্য ঠেকাতে পারা যাবে না। বেঁচে থাকলে প্রবীণ হতেই হবে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর আর্থিক-সামাজিক সংকট এক সময় কেটে যাবে। কারণ পৃথিবীতে অভাব বিষয়টি অনুপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রবীণ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির হার প্রবল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯ শতাংশ মানুষ প্রবীণ। ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশ মানুষ প্রবীণ হবেন। কারও পক্ষে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধি থামানো সম্ভব নয়। এক সময় শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকবে আর প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে। একই সঙ্গে কমতে থাকবে কার্যক্রম শক্তি। ফলে অর্থনীতিতে চাপ পড়বে, প্রবৃদ্ধির হার কমবে। এখনই উন্নত দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি হার প্রতি বছরই কিছু না কিছু কমছে। সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহে অনীহা কিংবা সন্তান জন্মদানে অনাগ্রহ বাড়তে থাকবে। বিবাহবিচ্ছেদকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। ভোগবাদী মানসিকতা তীব্র হওয়ার ফলে সন্তান জন্মদান এবং পরবর্তী পর্যায়ে লালন-পালন করার মতো ঝামেলাপূর্ণ কাজে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আগ্রহ অনেক কমে যাবে। সক্ষম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আবেগজনিত সংকট তীব্র হলে সন্তান জন্মদানের মানসিক চাহিদা কমে যাবে। কর্মব্যস্ত স্বামী-স্ত্রী দিন শেষে ইন্টারনেট আর ফেসবুকে সময় কাটিয়ে ভালোবাসাহীন ঘুম দেবে। সকালে উঠে আবার কর্মব্যস্ত দিনে প্রবেশ করবে। সন্তান জন্মদানের জন্য সরকারকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হবে। সরকার বাধ্য হয়ে ঘোষণা দেবে, যারা বিয়ে করবে তারা আর্থিক সহায়তা পাবে কিংবা বিনেপয়সায় ফ্ল্যাট পাবে। সন্তান জন্ম দিলে সরকারি চাকরি পাবে কিংবা বড় অঙ্কের টাকা পাবে। এমনও হতে পারে, যারা চারটি সন্তান জন্ম দেবে তারা আজীবন সরকারের কাছ থেকে পেনশন পাবে। এখন যেমন জন্ম ঠেকানোর জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, এমন সময় ভবিষ্যতে আসবে যখন সরকার কোটি কোটি টাকা সন্তান জন্মদানের জন্য খরচ করবে। সন্তান জন্মদানে প্রকৃতিও বৈরী হয়ে যাবে। এখন প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে একজন সন্তান জন্মদানে অক্ষম।

আবার অনেকেই একটি সন্তান জন্মদানের পর দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হয়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভবিষ্যতে ২০ শতাংশ নারী-পুরুষ সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হতে পারে। মানবিক রোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, আস্থা, বিশ্বাস দুর্বল হলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। সন্তান জন্মদান এবং লালন-পালন ব্যয়বহুল বিধায় অনেকের সন্তান জন্মদানের সামর্থ্য থাকলেও বেশি সন্তান নিতে চান না। ক্রমেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকবে। জন্মহার শূন্যের কোটায় নেমে যাবে। তারপর প্রবীণ জনগোষ্ঠী টিকে থাকবে আরও ৭০ থেকে ৮০ বছর। পরিস্থিতি পাল্টে যাবে, প্রবীণ প্রবীণের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়বে। কে কাকে সেবাযত্ন করবে তা নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হবে। এখনই বাংলাদেশে এমন ঘটনা অনেক আমি প্রত্যক্ষ করছি। আমি একজন ধনাঢ্য প্রবীণ নারীকে দেখেছি যিনি নিঃসঙ্গ অসহায় অবস্থায় দিন যাপন করছেন। বাংলাদেশের এক সময়ের ক্ষমতাবান একজন ধনী প্রবীণকে জানি, তিনি বেঁচে আছেন এটুকুই। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই পৃথিবী একদিন জনমানবশূন্য হয়ে পড়বে। ক্ষমতা দেখানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। সম্পদের পাহারাদার খুঁজে পাওয়া যাবে না। কলকারখানা বন্ধ হবে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর ক্রেতা না পাওয়ায়। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো অচল হয়ে পড়বে কর্মক্ষম শক্তির জোগান না থাকায়। একদিন বনজঙ্গল ধ্বংস করে, পাহাড়-পর্বত বিনাশ করে তথাকথিত সভ্যতা যেখানে গড়ে উঠেছিল সেখানেই বনজঙ্গলে ভরে যাবে। প্রকৃতির ওপর একদিন মানুষ যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি করে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে। শারীরিক সামর্থ্যরে অভাবে প্রবীণরা অসহায়ভাবে প্রকৃতির তাণ্ডব উপভোগ করবে। মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে সম্পদ ভোগ করেছিল, অবশেষে প্রকৃতির কাছে সম্পদ এবং নিয়ন্ত্রণ সমর্পণ করে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। এভাবেই মানবজাতি বিকাশের পথে একদিন বিনাশ হয়ে যাবে। সেটি এই শতাব্দীর শেষে কিংবা পরবর্তী শতাব্দীর প্রথম দিকে দৃশ্যমান হবে বলে আমার ধারণা।