ফিরবে কি পাটের সুদিন : পূরণ হবে কি কৃষকের স্বপ্ন

আলকামা শিকদার, গণমাধ্যমকর্মী

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে কৃষিপ্রধান একটি ভূখণ্ড। এখানকার অর্থনীতির প্রধান জোগানদার হচ্ছে কৃষি ক্ষেত্র। দিন যত যাচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি তত এগিয়ে যাচ্ছে। আর আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে কৃষি প্রযুক্তিতে। বাংলদেশের কৃষি উৎপাদিত ফসলাদির মধ্যে একসময় পাট অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখত। আর তাই সে সময় আদর করে এই ফসলটিকে সোনালি আঁশ বলে অভিহিত করা হতো। সোনার মতো চকচকে ও দামেও পাওয়া যেত সোনার দাম- তাই এটিকে সোনালি আঁশ বলতে কেউ কার্পণ্য করত না। এক সময় পাট ও পাটজাত দ্রব্যই ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস। স্বাধীনতার পর প্রথম বছর বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৮৪ ভাগেরও বেশি অর্জিত হয়েছিল পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। এজন্য পাটকে সোনালি আঁশও বলা হয়ে থাকে। দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও বাংলার কৃষকরা এই সোনালি আঁশের চাষ বাদ দেয়নি। ঐতিহ্যগতভাবে হলেও এটিকে তারা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। এ ফসল থেকে কৃষকরা আগের দিনের মতো সোনার দাম না পেলেও মোটেও আগ্রহ হারায়নি এর চাষাবাদ থেকে। তাই এখন প্রশ্ন যেহেতু কৃষকরা এ পাটের চাষাবাদ আকরে ধরে রেখেছে, সে অনুযায়ী কি তারা এর ন্যায্যা মূল্য পাবে? বাংলাদেশের সর্বত্র এখন সয়লাভ করেছে প্লাস্টিক। কী অফিসের কাজে, কী ঘরে, সব জায়গায় এখন প্লাাস্টিকের রাজত্ব। এমনকি আমরা আমাদের শিশুদের হাতেও নির্দ্বিধায় তুলে দিচ্ছি প্লাস্টিকের নানা জাতের রঙিন খেলনা। সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাবে। চলতি শতকে আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদন ও ভোগের মধ্যদিয়ে গিয়েছি, তা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরাট রেকর্ড। তাই যথাসম্ভব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার বিবণন ও বিক্রয়ের মাত্রা কমিয়ে আসতে হবে। তা না হলে পরিবেশ পড়ে যাবে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। তারই সঙ্গে ক্ষতির সম্মুখীন হব আমরা মানব জাতিও। প্লাস্টিকের এ দূষণের কারণে আমাদের পরিবেশ যেমন মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে হারাচ্ছে বিশাল জলরাশি সমুদ্র তার আপন পরিবেশ। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে মরতে হচ্ছে অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীকে। মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। এই অবস্থায় পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে দৈনিক সোনালি ব্যাগের (পাটের ব্যাগ) ব্যবহার বাড়াতে হবে। না হলে ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য হারাবে বাংলাদেশের কৃষি থেকে পাট নামক এই ফসলটি। সোনালি আঁশ পাটের হারানো দিন ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। মানসম্মত পাট উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন, পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ- এই পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে জাতীয় পাটনীতিতে। এছাড়া পাট নিয়ে উৎসাহ ও জনসচেতনতা যেমন বাড়ছে, তেমনি স্বপ্ন দেখার পরিসরটাও বড় হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের কার্যক্রম চালু করেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। এতে অর্থায়ন করছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড। তাছাড়া পরিবেশ বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন গবেষকরা দেখেছেন, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাটচাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে, আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয়েছে, যাকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পাটের ফলনে স্মরণকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের পাতা থেকে চা উদ্ভাবনের কথা শুনিয়েছেন সম্প্রতি। এটি পাটকে অর্থকরি ফসল হিসেবে পরিচিত করার আর একটি নতুন পদক্ষেপ বলেও ধরা হচ্ছে। পাটশাকের মেমন ভেষজ গুণ, তার সবটুকুই এই পাটের চায়ে পাবেন চা- প্রেমীরা। আর সে কারণেই এই চা খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা পাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তারা। সম্প্রতি জার্মানিতে এই চা রপ্তানি করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। হ্যাঁ, এই গল্পগুলো আমাদের সামনের দিকে চোখ মেলে তাকাতে বলে। পাটকে নিয়ে নতুন করে ভাবার স্বপ্নের জাল বুনতে সাহায্য করছে কৃষকদের। এক সময় বাংলদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট। রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাতও ছিল পাট। সেই দিন আর নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সবুজ পণ্য ব্যবহারের যে প্রবণতা বাড়ছে তাতে পাটের সেই সোনালি দিন ফেরার আশা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাট দিয়ে বাহারি ডিজাইনের ভীষণ নান্দনিক জুতা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া পাট দিয়ে ঢেউটিন থেকে চেয়ার, সবকিছু বানানোর কাজও চলছে। বর্তমানে আমরা প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানি করে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার পাই। কিন্তু মিলগুলো আধুনিকায়ন করার পর সেখানে পাটের শাড়ি, সোফার কভার ইত্যাদি পণ্য তৈরি করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে প্রতি টন পাট থেকে ১০ হাজার ডলারের পণ্য উৎপাদন করা যাবে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনটি পাটকলকে আধুনিকায়নের ফলে তিনটি পাটকলে ৫৩ দশমিক ৩৫ একর জমিতে বছরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পাট পণ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। সোনালি আঁশ খ্যাত বাংলাদেশের পাট বিশ্বসেরা। এ পাটের চাহিদা, গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। পাট উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং কাঁচা পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য থেকে জানা যায় যে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৯১ কোটি (৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে দেশ। এর মধ্যে ১০ কোটি ৩৫ লাখ ১০ হাজার ডলার এসেছে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। আর এসব পাটকলে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে ও দেশে বিক্রি ও রপ্তানি করে একটা মোট অঙ্কের আয়ের আশা করা হচ্ছে। এখন পাট কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে। কৃষকরা আগ্রহ ভরে পাট কেটে জাগ দেয়া থেকে শুরু করে শুকিয়ে বাজারজাত করা পর্যন্ত বিশেষ যত্ন নিয়ে রাখবে এই পাটের। তাই বাজারে যদি বিশেষ চাহিদা ও ন্যায্য মূল্য তারা না পায় তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে এ ফসল চাষ করা থেকে বেরিয়ে আসবে কৃষকরা। যার ফলে কমবে অক্সিজেন, উৎপাদনে ন্যুয়ে পড়বে অর্থনীতি। তাই বলা যায় যে, পাট বাংলাদেশের এক প্রধান অর্থকরী ফসল। পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও গবেষণার জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলাদেশের পাট শিল্প আরও বহুগুণ এগিয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করবে। পূরণ হবে কৃষকের আশা ও প্রত্যাশা।