ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সিনেমার মতো নাটকেও অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে

আলম শাইন, কলামিস্ট
সিনেমার মতো নাটকেও অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে

আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যাত্রাপালা, সিনেমা, সার্কাস কিংবা মঞ্চনাটক। নব্বই দশক পর্যন্ত এ শিল্পের জয়জয়কার ছিল চারদিকে। বাংলা সিনেমা তো প্রায় ২০০০ সালের পরেও দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে। অন্যদিকে অশ্লীল নৃত্য কিংবা ভ্যারাইটিজ শোর তাণ্ডবে যাত্রাপালা এবং সার্কাসের প্রদীপ নিভু নিভু করছিল ততদিনে। আমরা দেখেছিলাম, একসময় ব্যাপকভাবেই মঞ্চনাটক গ্রামঞ্চলে মঞ্চায়ন হতো। ঠিক একই কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে মঞ্চনাটক বিদায় নিলেও শহরাঞ্চলে মোটামুটি স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। শুধু অশ্লীলতা বর্জনের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে টেলিভিশন নাটকের প্রতি দর্শকদের যথেষ্ট আস্থা ছিল কয়েক বছর আগেও। কিন্তু সেখানেও অশ্লীলতা হানা দেওয়ার কারণে অথবা প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে দর্শকবিমুখ হয়ে পড়েছেন ইতোমধ্যেই। অথচ একটা সময় বাংলা নাটকের ব্যাপক জয়জয়কার ছিল দেশে। আমরা দেখেছি, বাংলা নাটকের দৃশ্যপট পরিবর্তনের জন্য অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রের ফাঁসি ঠেকাতে রাজধানীতে মিছিলও হয়েছিল। ভাবা যায় কতটা জনপ্রিয় ছিল বাংলা নাটক তখন! আর বর্তমানে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঠিক যাত্রা-সিনেমার মতো নাক সিঁটকাচ্ছেন রুচিসম্মত শ্রেণির দর্শকরা; কিংবা যিনি বোধসম্পন্ন মানুষ বাংলা নাটকের নাম শুনলেই এখন দুরদুর করছেন তিনিও। অবস্থা এমন হয়েছে যে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাংলা নাটক দেখা যাচ্ছে না এখন আর। অশ্লীল সব অঙ্গভঙ্গি ও ডায়ালগ থ্রো করে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছেন দর্শকদের। বিশেষ করে ইউটিউবের জন্য নাটক বানিয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন তারা। নামিদামি শিল্পীরাও অশ্লীল ডায়ালগ থ্রো করছেন। ফলে খুব দ্রুত নাটকবিমুখ হচ্ছেন দর্শক। যেমন ইউটিউবে কয়েকজন কৌতুক অভিনেতার নাটিকা এত বেশি নজরে পড়ে, যা দেখলে বমির উদ্রেক হয় দর্শকদের। তারা এত অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করেন, যা শুনলে যে কেউ একাকী দেখলেও লজ্জিত হবেন। অথচ এই কৌতুক অভিনেতারা এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, বেতারে এবং টেলিভিশনের নাটকেও সরব ছিলেন তারা। সেই তাদের এই হাল দেখে রুচিসম্পন্ন মানুষ কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছেন না। আঞ্চলিক ভাষার তাদের এই নাটিকাগুলো তথাকথিত নায়িকাদের উদ্দেশ্যে কুরুচিপূর্ণ ডায়ালগ বলতে থাকেন অহেতুকই।

বিশ্রী সব অঙ্গভঙ্গি আর বিশ্রী সব পোশাক-আশাকে তাদের সংয়ের মতো দেখায়! এই কুরুচিসম্পন্ন অভিনেতাদের নাম ধরে বলতে পারলে আমরা মনে শান্তি পেতাম খানিকটা; কিন্তু তাদের আত্মসম্মানের বিষয়টাকে প্রাধান্য দিয়ে সেই চেষ্টা থেকে বিরত রইলাম। আসলে এখানে আত্মসম্মানের কথা বলাটা ভুল হয়েছে; কারণ তাদের ওই জিনিসটা নেই, তা নিশ্চিত বলা যায়। এবার সিনেমার কথায় আসা যাক। দেশে এক সময় ১ হাজার ৪৩৫টি সিনেমা হল ছিল। প্রতি সপ্তাহে এসব হলে নতুন ছবি দেখানো হতো তখন। এত দর্শক ছিল যে, টিকিট তখন কালোবাজারিও হতো ব্যাপকভাবে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপেরও প্রয়োজন হতো। সিনেমার কাহিনী কিংবা গান ওই সময় মানুষের মুখে মুখে থাকত। বিশেষ করে সিনেমা তখন ছিল সাহিত্যনির্ভর। ফলে খুব সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে বাংলা সিনেমা। অথচ সেই জনপ্রিয় মাধ্যমটিকে ধরে রাখতে পারেনি কতিপয় প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনয় শিল্পীর নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে।

তারা অশ্লীল ছবি বানিয়ে দর্শকদের ধোঁকা দিতে লাগল যেদিন থেকে, সেদিন থেকেই রুচিসম্মত দর্শকদের হারাতে থাকল। পরবর্তী সময়ে ইউটিউবের কারণে নিম্নœশ্রেণির দর্শকদেরও হারাতে থাকল বাংলাদেশি সিনেমা। অর্থাৎ দুর্গন্ধে প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশি সিনেমা বিলীন হতে লাগল এবং হলের সংখ্যা দ্রুত কমতে লাগল। কমতে কমতে বর্তমানে সিনেমা হলের সংখ্যা ৬২টিতে দাঁড়িয়েছে। এ সংখ্যা আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে শূন্যের কোটায় নেমে আসা অসম্ভবের কিছুই নয়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশি সিনেমা এখন কোমায় অবস্থান করছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুম্বাই অথবা তামিল সিনেমার এখনো জয়জয়কার রয়েছে। তারা এই মাধ্যমটাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অশ্লীলতা সেখানেও রয়েছে; কিন্তু মূল ধারার সিনেমায় তারা যতটা পেরেছে অশ্লীলতা মুক্ত রেখেছে, কাহিনির প্রয়োজনীয়তাটাই তারা চিত্রে ব্যবহার করেছে শুধু। সিনেমার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কতিপয় প্রযোজক, পরিচালকসহ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীও। তারা রাতারাতি সুপারস্টার হতে চেয়েছেন যেমন, তেমনি প্রযোজকরা লগ্নির টাকা দ্রুত উঠাতে কিংবা বেশি লাভবান হতে গিয়ে অশ্লীলতার দ্বারস্থ হয়েছেন, ফলে আম-ছালা সব খুইয়েছেন। ঠিক সেই পথটিই অনুসরণ করছে এখন বাংলা নাটকও। বিশ্রী সব কথোপকথন ও অঙ্গভঙ্গির কারণে নাটক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন দর্শকরা। তার ওপর বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, বাংলা নাটকেরও সলিল সমাধি ঘটতে যাচ্ছে দ্রুতই, যা টিকিয়ে রাখতে হলে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এক্ষুণি। তবেই টিকে থাকবে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির খণ্ডিত অংশ। এখানে আরেকটি কথা বলতে হচ্ছে, যে নাটিকাগুলো ইউটিউবে আপলোড করা হচ্ছে অথবা ইউটিউবের জন্য বানানো হচ্ছে, সে নাটিকাগুলোর অধিকাংশরই স্ক্রিপ রাইটার নেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই সব কিছু করেন। কাহিনি (কাহিনি তো নেই-ই) চিত্রনাট্য, ডায়ালগ, প্রযোজক, পরিচালক একজনই সব; আর তিনি হচ্ছেন, অভিনেতা কিংবা অভিনেত্রী নিজেই। নাটিকাতে পুরোনো কৌতুক আর পুরোনো কিছু প্রচলিত কাহিনির ছিটেফোঁটা থাকে অবশ্য, তবে তা ধার করা অথবা মেরে দেওয়া। সেই ক্ষেত্রেও কৌশল করে থাকেন তারা। যেমন : কেউ কেউ গল্প আহ্বান করেন। লেখক তাদের গল্প জমা দিলে এবং যোগাযোগ করলে তা মনোনীত হয়নি বলে জানান। পরে সেই গল্পের থিম নিয়ে নাটিকা বা নাটক বানিয়ে দর্শকদের উপহার দিতে চেষ্টা করেন। নাটকের অনেক নামিদামি পরিচালকও এই ধরনে হীন কাজটি করে থাকেন। এই গেল সিনেমার বিষয়; আরেকটি বিষয় হচ্ছে, হালের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুক, যাকে বলা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। এই মাধ্যমটিও কলুষিত হয়ে গেছে অনেক আগেই। যার যা খুশি তাই-ই পোস্ট করছে ফেসবুকে; তার ওপর বিভিন্ন ধরনের অপ্রচার তো করছেই।

আর ফেসবুকে যেসব ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেসব বোধকরি আর খুলে বলার প্রয়োজন নেই, কারণ সবাই প্রতিনিয়ত সেই ভাষাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছেন। কুরুচিপূর্ণ সেই ভাষা ব্যবহারকারী বা ভাষা ‘ধর্ষণকারী’ মানুষগুলোর সাক্ষাৎ আমরা না পেলেও মনের আয়নায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসামাজিক মানুষগুলোর মুখচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি। যে মানুষগুলোর ছবি দেখেও লজ্জিত হচ্ছি আমরা। তাই এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের প্রত্যাশা কিছু নীতিমালার; তাতে ফেসবুক ইউটিউবের ব্যবহারের জনপ্রিয়তা বাড়বে বৈ কমবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত