ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধনী) আইন ও খেলাপি ঋণ

মো. মাঈন উদ্দীন, অর্থনীতি বিশ্লেষক

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংক খাতের সংকট নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কম আলোচনা হচ্ছে না। বরং সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যা বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বিকাশের অন্যতম অন্তরায়। খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্রে ব্যাংক খাত বন্দি হয়ে আছে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় সুযোগ গ্রহণ করে ব্যাংক খাতকে দিন দিন ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদের তথ্য অনুযায়ী দেশে খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ জন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং পর্যন্ত দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে খেলাপী ঋণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি গ্রাহকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বমুখিতা ব্যাংক খাতের জন্য অশনিসংকেত। এতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার নগণ্য। মাঝেমধ্যে ভালো গ্রাহকরাও সময়মতো ঋণ পরিশোধে অনীহা প্রকাশ করে। এর মধ্যে সরকারের সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস ব্যাংক খাতের সংকটকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আইএমএফ সংকট উত্তরণের জন্য খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য পরমর্শ দিলেও সরকার বর্তমান যে পলিসি গ্রহণ করেছে, তাতে ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা আরো নড়বড়ে হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল সংশোধনী এনে ব্যাংক কোম্পানি বিল সংসদে উত্থাপন করলে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধনী) বিল ২০২৩ মহান সংসদে পাস হয়।

সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি বা গ্রুপের কোনো কোম্পানি খেলাপি হলেও ওই গ্রুপের বা ব্যক্তি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কোম্পানিকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে না। তাদের নতুন ঋণ পেতে সমস্যা হবে না। অথচ পরিচালক পর্ষদে থাকা, মেয়াদ বৃদ্ধি ও জাল জালিয়তি প্রবণতা কমিয়ে খেলাপি ঋণের হার হ্রাস করার কথা। কিন্তু সরকার যে সংশোধনী পাস করেছে, তাতে হিতেবিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিচালকরা পর্ষদে টানা ১২ বছর থাকতে পারবে। প্রতি মেয়াদে তিনবার করে ৪ মেয়াদে থাকতে পারবে। আগে ৩ মেয়াদে থাকতে পারত, টানা ৯ বছর। এক্ষেত্রে ৩ বছর বাড়ানো হয়েছে। ১২ বছর পর ১ মেয়াদ বাদ দিয়ে আবার ১২ বছর থাকতে পারবে। এভাবে আজীবন থাকতে পারবে। ২০০১ সালের পর ব্যাংক পরিচালকের মেয়াদ ৩ বছর করে টানা ৬ বছর থাকার বিধান করা হয়। একইসঙ্গে একই পরিবারের দুইজন পরিচালক থাকার বিধান করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একই পরিবারে প্রথমে তিনজন ও পরে চারজন করা হয় এবং পরিচালকদের মেয়াদও বাড়ানো হয়। এভাবে পরিচালক পর্ষদের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে ব্যাংকে তাদের কর্তৃত্ব আরো বাড়বে। প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। আইএমএফ-এর চাপে এই সংশোধনী আনলেও সুশাসনের ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। সূত্র থেকে জানা যায়, ব্যাংক পরিচালকরা অর্থের জোগান দেয় মাত্র আট শতাংশ বাকি ৯২ শতাংশই আমানতকারীদের। এই কারণে ব্যাংক পরিচালকরা নিজেদের মালিক ভাবতে পারে না। তারা বড়জোর নিজের উদ্যোক্তা ভাবতে পারেন। অথচ দেখা যায়, পরিচালকরা নিজেদের মালিক ভেবে ব্যাংকে প্রভাব সৃষ্টি করে। এতে করে নানা অনিয়ম, কেলেঙ্কারি সৃষ্টি হয়। ব্যাংকারদের ওপর নানা চাপ সৃষ্টি করেন। ঋণ বিতরণে নানা অনিয়মও দেখা দেয়। ঋণখেলাপি হয়। খেলাপির পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে। আমানতের খেয়ানত হয়। ফলে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কমে যায়, সংকট আরো বাড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে একই পরিবারের পরিচালক হওয়ার সংখ্যা কমানো উচিত একই সঙ্গে পরিচালকদের মেয়াদও কমানো উচিত। ব্যাংক কোম্পানিস সংশোধীত আইনে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলতে উল্লেখ করা হয়েছে কোনো ব্যক্তি ২০ শতাংশ শেয়ার থাকলে ওই কোম্পানিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে কোম্পানি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানি হিসাবে গণ্য হবে। এর ফলে কোনো পরিচালকের ২০ শতাংশ এর কম শেয়ার থাকলে সে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, সে অন্য নামে ঋণ নিতে সমস্যা হবে না। এতে ঋণ অনিয়মের সুযোগ তৈরি হতে পারে, আবার পরিচালক হওয়ার ক্ষেত্রেও সুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যেমন একই পরিচালক কখনো মূল পরিচালক, কখনোবা বিকল্প বা আমানতকারীদের মধ্য থেকে পরিচালক নির্বাচিত হয়ে পরিষদে থাকতে পারবেন। কারণ এক্ষেত্রে আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। সংশোধনীতে পরিচালকদের অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত তাও উল্লেখ নেই। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা, অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। অথচ প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে ভূমিকা পালন না করেও কেউ কেউ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। বর্তমান আইনে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা প্রণয়নের ক্ষমতা কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ওপর দেওয়া হয়েছে। সংশোধনী আইনেও তা রাখা হয়েছে। ২০২০ সালে কেন্দ্রিয় ব্যাংক সার্কুলার দিয়ে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। এতে কোনো ঋণ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৬ থেকে ৯ মাস পর খেলাপি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ ৩ মাস থেকে ৬ মাস পর খেলাপি হয়। আমাদের দেশে এক্ষেত্রে ৩ মাস ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ কম দেখানো সম্ভব হচ্ছে। যদিও আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এক্ষেত্রে আপত্তি রয়েছে। তারা একে আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে। সংশোধীত আইনের একটি ভালো দিক হলো, কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের শেয়ার মালিক হলে তার প্রতিনিধি হিসাবে অন্য কোনো ব্যক্তিকে পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রাহকরা বিদেশ ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার ক্ষমতার সদ্য ব্যাবহার করা উচিত। ঋণ খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে বকেয়া কিস্তির ৫০ শতাংশ বা অর্ধেক দিলেই ওই গ্রাহককে খেলাপি হিসাবে দেখানো যাবে না। এর ফলে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের জন্য যে একটি ভয়, পেরেশানি কাজ করত, সেটা আর থাকছে না। ফলে খেলাপি আরো বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ প্রভাবশালী, রাজনৈতিক গোষ্ঠী, ব্যবসায়ীর প্রচণ্ড একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী দেশের অর্থনীতি ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ব্যাংক বিমা, সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে। রাজনীতি, ব্যবসা, ব্যাংকিং, বিমা সব একাকার। সবকিছু চলে গেছে মধ্যস্বত্বভোগী ও দালাল শ্রেণির হাতে। ফলে সুবিধা থেকে উৎপাদকরা বঞ্চিত হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে ভোক্তারা। আমাদের কৃষকরাও নানা দিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ পায় না, পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না। তাদের খরচ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আর্থিক খাতকে সংকটমুক্ত করতে হলে কৃষকদেরও বাঁচাতে হবে। মূল্যস্ফীতি রোধে কৃষকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধি দেখা দিলেও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের অসংগতি। ব্যাংক খাত হলো অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। আর এই খাত যদি নড়বড়ে হয়। তাহলে ব্যাবসা-বাণিজ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। সার্বিক অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। সেখানে দেশে এখন বিতরণ করা ঋণের গড়ে ৮ শতাংশের অধিক খেলাপি। তাই যেসব সমস্যার জন্য খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তা চিহ্নিত করা উচিত। নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও ভালো করে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে। এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করা উচিত। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিকল্প নেই। রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্বজনপ্রীতি ও মন্দার প্রভাব দেখিয়ে ঢালাওভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়া উচিত নয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী না করে চলমান যে সংকট তথা ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতি, বাণিজ্য ঘাটতি, ব্যাংক ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার, ঋণনির্ভর ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতার বৃদ্ধির ঘটনা, রিজার্ভের হ্রাস, অর্থনীতিকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। দেশের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি দমন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা ও সুশাসন থাকলে সংকট বছরের পর বছর থাকত না। তাই আর্থিক খাতকে মজবুত ও টেকসই করতে হলে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি রোধ করা, ব্যাংকের কাঠামো পরিবর্তন যৌক্তিক করা উচিত। অভিজ্ঞ, দক্ষ, নিরপেক্ষ পরিচালক মণ্ডলী স্থাপন করা উচিত। ব্যাংক খাতের জন্য আন্তর্জাতিক রীতি মেনে চলা ও ব্যাংকের বিনিয়োগ, আমানতকারীদের আস্থা বৃদ্ধি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করা উচিত। পরিশেষে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করার মাধ্যমে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সবারই প্রত্যশা।