ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাকিস্তান, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আম কূটনীতির তাৎপর্য

সামিনা আক্তার
পাকিস্তান, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আম কূটনীতির তাৎপর্য

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শেহবাজ শরিফকে ১ হাজার ৫০০ কেজি আম উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশন ১০ জুলাই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল অফিসারের কাছে আমগুলো হস্তান্তর করে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই উপহার গ্রহণ করেছে। এক বিবৃতিতে পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপহার দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে এবং পারস্পরিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে, আমের জ্বর ভারত এবং সমগ্র উপমহাদেশকে গ্রাস করে। প্রিয় ‘ফলের রাজা’ ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল, আর আমগাছ বাংলাদেশের জাতীয় গাছ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমের সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কথা স্বীকার করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ফলটি ব্যবহার করছেন। চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ডে আম পাঠিয়েছিল। ১৫ জুন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা ৫০০ কেজি আম পেয়েছেন। ১৩ জুন, নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নিফিউ রিও একই উপহার পেয়েছিলেন। একইভাবে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও ১২ জুন আম পেয়েছেন। আমের এই কূটনীতি শুধুমাত্র উত্তর-পূর্ব রাজ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১২ জুন পিটিআই দ্বারা রিপোর্ট করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির পাশাপাশি অন্যান্য ভারতীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে যেমন সোনিয়া গান্ধী, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতা এবং মমতা ব্যানার্জি, মুখ্যমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে মৌসুমি আম পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশ এবারই প্রথম আম কূটনীতির উদ্যোগ নিল না। আসলে প্রতি বছরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তর-পূর্ব ভারতে আম পাঠান। গত বছরও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীদের উপহার হিসেবে আম পাঠানো হয়েছিল। মাধুর্যের সঙ্গে জয়ী হওয়ার এই ধরনের প্রচেষ্টা কূটনীতির প্রকৃত পরীক্ষা হিসাবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে, যখন পাকিস্তান তার ‘আম কূটনীতি’র অংশ হিসাবে ৩২টিরও বেশি দেশের প্রধানদের কাছে আম পাঠিয়েছিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো দেশগুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল। কয়েকদিন আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে আম পাঠিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ তার বিশাল প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় বলে ভারতে আম পাঠানোর অর্থ হয়। কিন্তু পাকিস্তানকে ফল দেওয়াও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পঞ্চাশ বছর পর, আম বিনিময় একটি ইঙ্গিত যে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব। আম রপ্তানিকারকদের মধ্যে শীর্ষ ১০টি দেশও রয়েছে। ইসলামাবাদের সৌজন্যে গত বছর বাংলাদেশের নেতারা বিখ্যাত পাকিস্তানি আম পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের আম কূটনীতির কথা জানা যায়। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তান যখন চীনা কমিউনিস্ট নেতাকে আম উপহার দিয়েছিল তখন মাও হতবাক হয়েছিলেন। গত বছরও শেখ হাসিনা শুভেচ্ছার ইঙ্গিত হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্লভ হাঁড়িভাঙা আম পাঠিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের চারপাশে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমের সংস্কৃতি বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, নেপালের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, ভুটানের রাজা ও প্রধানমন্ত্রী, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর কাছে শত শত কেজি আম পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরামের মতো কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছেও আম পাঠানো হয়েছে। বেশির ভাগই রংপুরের বিখ্যাত সুস্বাদু পটেড আম। আরও আছে কিছু ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর। জাতীয় ফল কাঁঠালও পাঠানো হয়েছে কয়েকটি দেশে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে চা, মধু, আনারস, জৈব মশলা ইত্যাদি পাঠানো হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এখনও ‘আম কূটনীতি’ হাতিয়ার মমতা-হাসিনার কাছে বন্ধুত্ব মজবুত করতে আম পাঠানোর পুরনো কূটনৈতিক কৌশল। আমকে ঘিরে কূটনীতি নতুন নয়, তা বর্তমান সময় হোক বা রাজাদের রাজত্ব। হিমসাগর, ল্যাংড়া এবং লক্ষ্মণভোগকে দিল্লিতে পাঠিয়ে আমের কূটনীতি বজায় রেখেছেন মমতা। তবে শুধু দেশীয় রাজনীতিতেই নয়, দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে বা বিদেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণের হাতিয়ার হিসেবেও তা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমাদের ভ্রাতৃত্ব ও উষ্ণতার দূত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি আমের কোনো ব্র্যান্ডিং নেই। রপ্তানিকারকরা বলছেন, গত মৌসুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে আম পাঠিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ খবর বাংলাদেশি আমের নতুন ব্র্যান্ডিং তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা উল্লেখ করেন, এর পর থেকে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি আমের রপ্তানি আদেশ বাড়ছে। এমনকি কোনো ব্র্যান্ডিং ছাড়াই আম রপ্তানিতে বড় উল্লম্ফন দেখা যায়। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টন আম উৎপাদন করে যার বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা।

ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক : দুই সরকার ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে কাজ করলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশের জনগণ একে অপরের কাছ থেকে লাভবান হতে পারে। ঢাকা আশা করছে, শেহবাজ শরিফ ভালো কাজ চালিয়ে যাবেন। ইমরান খান বাংলাদেশের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ককে দৃঢ় করার জন্য কাজ করছিলেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সফর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতির দিকে একটি পদক্ষেপ হতে পারে। দুই প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য সফর করতে পারেন। হ্যাঁ, এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ।

পাকিস্তানকে অসামান্য সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। অনেক সম্ভাবনা আছে, আর তাই ঢাকাকে এখন অর্থনৈতিক অলৌকিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মিল রয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বাড়ছে এবং বছরের শেষ নাগাদ ১ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশ আগামী ২৭ জুলাই ডি-৮-এর মন্ত্রিপরিষদের ২০তম অধিবেশনের আয়োজন করবে, যা ডেভেলপিং-৮ নামেও পরিচিত। ঢাকায় বৈঠকে পাকিস্তান যোগ দিতে পারে। এই পরিমিত প্রচেষ্টা উভয় পক্ষের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জনে পরিণত হবে। এটা পদস্থ কর্মকর্তাদের সফর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে একটি পদক্ষেপ হতে পারে। বেড়া মেরামত করতে দুই প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য সফর করতে পারেন। উভয় দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা সফর বিনিময় করতে পারেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাংলাদেশের মৌলিক অপরিহার্য পররাষ্ট্রনীতি, যে জাতি শান্তিকে মূল্য দেয়। রাষ্ট্র খুবই উদার। পাকিস্তানের সামনে পরিস্থিতির উন্নতির দুর্দান্ত সুযোগ রয়েছে। যদিও এমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে যেখানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এখন বিশ্বের অবস্থা বুঝতে হবে। ভৌগোলিকভাবে উভয়ই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ। এই প্রক্রিয়ায় পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বাংলাদেশ শিগগিরই দক্ষিণ এশিয়ার বাঘে পরিণত হতে চলেছে। এটি একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি আছে, বাংলাদেশ তাদের ব্যবসায়িক সংযোগের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে। নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে তার সংযোগ বজায় রাখা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসার ঘটছে। পাকিস্তানের উন্নতির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাদের একসঙ্গে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কিছু মিল রয়েছে। পারস্পরিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ উদ্যোগ এবং আঞ্চলিক সংযোগ অন্যান্য খাত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাংলাদেশের হাইকমিশনার রুহুল আলম সিদ্দিক সম্প্রতি বলেছেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বাড়ছে এবং এটি বছরের শেষে ১ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। সে দেশের এই বিখ্যাত, সুস্বাদু আম উপহার দেওয়ার জন্য হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে পাকিস্তান। এই উপহার দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। যাইহোক, ফলস্বরূপ, উভয় দেশের নীতিনির্ধারকদের এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আম কূটনীতি একটি ছোট উদ্যোগ; কিন্তু এটি একটি বড় প্রভাব আছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এই উদ্যোগ উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষকেই সচেতন হতে হবে। উপলব্ধি অনুকূল হলে, সরকার এবং দেশের নাগরিক উভয়ই লাভবান হবে।

লেখক : মানবাধিকারকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত