ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আমাদের মস্তিষ্ক

মেহেদী হাসান নাঈম, লেখক ও শিক্ষার্থী
প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আমাদের মস্তিষ্ক

মানবদেহের প্রধান অঙ্গ হলো মস্তিষ্ক, যা দ্বারা মানুষ সম্পূর্ণ শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি সুষুম্নাকাণ্ডের সঙ্গে মিলে মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠন করে। মানুষের মস্তিষ্ক গুরুমস্তিষ্ক, মস্তিষ্ককাণ্ড ও লঘুমস্তিষ্ক নামক তিনটি অংশ নিয়ে গঠিত। যা মানবদেহের সিংহভাগ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অবাক করা তথ্য হলো, সেই মস্তিষ্কই অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রযুক্তি দ্বারা। প্রবন্ধের শুরুতেই বিষ্ময়কর সূচনা পাঠকের মস্তিষ্ককেই নাড়া দিতে পারে। তবে বাস্তবতায় দৃষ্টিপাত করলে আমারা সহজেই বুঝতে পারি প্রবন্ধের প্রেক্ষাপটটিকে।

আসুন সোশ্যাল মিডিয়া দিয়েই শুরু করা যাক। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কারণে কিংবা অকারণে কিশোর থেকে শুরু করে বুড়ো সবাই ডুব দিই বিভিন্ন সোশ্যাল সাইটে। ৫ থেকে ১০ মিনিটরে কোনো কাজ করতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করে কখন যে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পার হয়ে যায় আমরা বুঝতেই পারি না। আর একটু নির্দিষ্ট করে যদি বলি, ধরুন আপনি কোনো ভিডিও দেখছেন। সেটি হতে পারে ফেইসবুক, ইউটিউব কিংবা অন্য কোনো অ্যাপলিকশন। আপনি যেই ভিডিও দেখছে সেটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার সামনে একই ধরনের ভিডিও অটোমেটিক চলে আসে। তখন আপনি প্রয়োজন না হলেও সেই ভিডিও দেখতে শুরু করে দেবেন। এটি অনেকটা সাইকোলোজি রিড করার মতো। আপনি কী ভাবছেন, কী চিন্তা করছেন বা কী সার্চ করছেন তা প্রযুক্তি বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী আপনাকে ফিডব্যাক দিতে থাকে। প্রযুক্তির এমন নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আমদের সচেতন হতে হবে। কয়েক বছর আগে যেখানে মানুষ এক ডজন ফোন নম্বর মনে থাকত, এখন নিজের নম্বরই মনে করতে কষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ অনলাইন পাঠক বড় প্রবন্ধের জায়গায় কয়েক শত শব্দের ছোট লেখা পড়তে পছন্দ করেন। আর আমরা প্রত্যেকেই এমন কাউকে চিনি, যিনি আধা ঘণ্টাও স্মার্টফোনে একবার চোখ না বুলিয়ে থাকতে পারেন না।

২০১৫ সালে কানাডায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তারা কোনো বিষয়ে গড়ে মাত্র ৮ সেকেন্ড মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। যেখানে গোল্ডফিশ মানুষের চেয়ে এক সেকেন্ড বেশি মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। এর ১৫ বছর আগের একটি গবেষণা অনুসারে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার স্থায়িত্ব ছিল গড়ে ১২ সেকেন্ড। শুধু উল্লি­খিত গবেষণা নয়, ২০১২ সালের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও পুয়ের্তো রিকোর হাজার হাজার শিক্ষকের পরিচালিত জরিপ বলছে, এখনকার স্কুল শিক্ষার্থীরা বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। মাত্র ১৫ বছরে এমন কী হলো যে উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতার এত অবনতি ঘটল? প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্ককে বদলে দিচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নের উত্তর মেলে ওপরের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য দ্বারা।

এই শতাব্দীর শুরু থেকেই মোবাইল ফোন, বিশেষ করে স্মার্টফোন মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সহজলভ্য এই প্রযুক্তি পারস্পরিক যোগাযোগ যেমন সহজ করে দিয়েছে, তেমনি মেসেজ, চ্যাট, ফেসবুক নোটিফিকেশনসহ অজস্র তথ্যে ক্ষণে ক্ষণে আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রসার এবং মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাওয়া- এ দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী অধ্যাপক রাসেল পোল্ডরাক যেমন ভাবছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি নিশ্চিত যে, প্রযুক্তির কারণে আমাদের অপেক্ষা করে মনোযোগ দেওয়ার ধৈর্য কমে গেছে। আর তাৎক্ষণিক তথ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে।’ প্রযুক্তি মানুষকে অনেকাটা বানিয়ে ফেলেছে নিয়ন্ত্রিত পুতুল মানব।

প্রযুক্তির সহায়তায় অনেক অসাধ্য সাধন করা গেলেও এর কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে সমগ্র মানবজাতি। ম্যাপল হলিস্টিকসের স্বাস্থ্য ও সুস্থতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ক্যালেব ব্যাক বলেছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তা স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে এবং ঘাড়ে চাপ তৈরি করে। ফলে মাথাকে স্থির রাখতে ও স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় ঘাড়ের পেশিগুলোকে আরো বেশি শক্তি ব্যয় করতে হবে। এছাড়া দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ব্যবহার করলে সেটি শরীর থেকে ঘাড়ের অংশ ভবিষ্যতে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসবে। প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে মানবদেহে আরো এক ধরনের অসংগতি তৈরি হবে। মেড অ্যালার্ট হেল্পের একজন ডাক্তার ও সহপ্রতিষ্ঠাতা নিকোলা জর্ডজেভিচের দাবি, স্মার্টফোন বা সেলফোন যেভাবে হাতে ধরা হয়, সেটি নির্দিষ্ট যোগাযোগ প্রক্রিয়ার চাপ প্রয়োগ করবে, যা টেক্সট ক্ল তৈরি করবে।

প্রযুক্তি বা ডিভাইসের অত্যধিক ব্যবহার ভবিষ্যতে কনুইয়ের অবস্থান ৯০ ডিগ্রিতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে। টেক্সট ক্ল ও কিউবিটাল টানেল সিনড্রোমে আরো একধাপ পরের অবস্থা হচ্ছে এটি। আলনার স্নায়ু মূলত কনুইয়ের ভেতর একটি ভাঁজের মধ্যে থেকে পরিচালিত হয়। অত্যধিক স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে এটি সংকুচিত হয় ও চাপের মধ্যে থাকে। যে কারণে ধীরে ধীরে এর অবস্থান পরিবর্তন হবে এবং মানবদেহের স্বাভাবিক গঠনকে প্রভাবিত করবে।

গবেষকরা আরো দাবি করেন, ভবিষ্যতে স্মার্টফোনের ক্ষতিকর তরঙ্গ থেকে ব্রেনকে সুরক্ষিত রাখতে মানুষের মাথার খুলি আরো মজবুত হবে। সেই সঙ্গে চোখের ওপর চাপ কমাতে ও নীল আলোর প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে দুই স্তরে পাপড়ি তৈরি হবে।

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রযুক্তি যে আমাদের জীবনযাত্রার মান সহজ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনো কিছুরই অতিরিক্ত ব্যবহার উচিত নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, সব ইতিবাচক জিনিসের অন্তরায় রয়েছে নেতিবাচকতা। এ ব্যপারে আমাদের জানতে হবে, সবাইকে জানাতে হবে এবং সর্বোপরি মানতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত