ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য

মাহমুদুল হক হাসান
কিশোর অপরাধ ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য

কিশোর গ্যাং বর্তমান সমাজে একটি আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা হু হু করে বাড়ছে। কিশোর গ্যাং এখন পত্রিকার পাতার নিয়মিত শিরোনাম। শহর থেকে গ্রাম, পাড়ার মহল্লা, অলিগলিতে গ্যাং পার্টির উৎপাতে জনমনে বিরাজ করছে এক ধরনের আতঙ্ক। এ পৃথিবীতে কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। শিশু-কিশোররা সাধারণত পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, পরিবেশ ও প্রতিবেশীর প্রভাব, পরিপার্শ্বিক অবস্থা অপরাধীদের সঙ্গে সংমিশ্রণ অসৎ বন্ধুদের খপ্পর এবং বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে অপরাধী হয়ে ওঠে। বিস্তৃত হচ্ছে অপরাধচক্র। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গ্যাং। সমাজের জন্য ক্যান্সারূপী এই গ্যাং পার্টি জালের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, বখাটে, খুন, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকের চোরাচালান চালান, গুম ও খুনের মতো সব নৃশংস, হিংস্র ও নিকৃষ্ট ন্যক্কারজনক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। বিষয়টি শুধু অভিভাবকদের জন্যই আতঙ্ক নয় বরং কিশোর অপরাধ একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর মহামারি। সাধারণত সাত থেকে ১৬ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের দ্বারা ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু-কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধই হলো কিশোর অপরাধ। তথ্যমতে, ঢাকায় ছোট-বড় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০০ আর সারা দেশের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭০০। শিশু-কিশোররা যদি বিপথে চলে যায়, নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা দেশ ও জাতির জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। কিশোর গ্যাং হালের মূর্তিমান আতঙ্কের রূপে দেখা দিয়েছে। চুরি, ডাকাতি, যৌন হয়রানি, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ, মাদক, অস্ত্র চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ ভয়ংকর সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতায়।

স্বাধীনতাও যে একটা সীমাবদ্ধতা আছে সেটা এই কিশোররা মানতে নারাজ। ঢাকার শিশু আদালতের নথি অনুযায়ী কিশোরদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে গত ১৫ বছরে রাজধানীতে ৮৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কোনো অপরাধই সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনে না। রাজধানীতে প্রতি মাসে গড়ে ২০টি হত্যার ঘটনা ঘটে। এর বেশিরভাগ ঘটনায় কিশোর অপরাধীরা জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০টি খুন হয়েছে। কিশোর অপরাধ রোধে রাত ১০টার পর অলিগলিতে আড্ডাবাজদের চিহ্নিত করে প্রশাসনের উচিত কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। পাশাপাশি গ্যাং পার্টি উচ্ছেদ করতে এলাকাভিত্তিক অপরাধবিরোধী চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কিশোর অপরাধ দমন অসম্ভব কিছু নয়। আজকের শিশু-কিশোররা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

তাদের দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হওয়া মোটেই কাম্য নয়। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, কিশোররা যেন অপরাধে জড়াতে না পারে এবং তাদের কেউ অসৎ কাজে ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে অভিভাবকদের সজাগ থাকতে হবে। শিশু-কিশোরদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

শিশু-কিশোরদের সব ধরনের অপরাধ থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে- এ ব্যাপারে পিতা-মাতার নিবিড় পর্যবেক্ষণ দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি যথেষ্ট সুযোগদানে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এরই মধ্যে অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের উপযুক্ত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিশোর গ্যাংগুলোর বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে অপরাজনীতির ছত্রছায়ার পাশাপাশি আইনের ফাঁকফোকরও দায়ী। বাংলাদেশ শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি যেসব শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের জেলে না পাঠিয়ে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।

এ ব্যাপারে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর অপরাধ আইন সম্বন্ধে আরো ভাবা দরকার।

খুনের মতো নিকৃষ্ট ভয়াবহ অপরাধ করেও কিশোর অপরাধীরা সাজা না পেয়ে ফের অপকর্মে জড়িত হচ্ছে। কিশোর অপরাধ দমনে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যম এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ একান্ত কাম্য। কিশোর গ্যাং রোধকল্পে সবার সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত