ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিয়ের বয়স নির্ধারণ

অসম বিয়ে সামাজিক সমস্যাও বটে
বিয়ের বয়স নির্ধারণ

রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী ও পুরুষের বিয়ের একটা বয়স নির্ধারণ করে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন অনুভূত হচ্ছে। ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান ধারণ মা ও নবজাতকের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে মনে করা হয়। সে কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সন্তান ধারণের এই বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিয়ের কোনো ধরাবাঁধা বয়স নেই। মানুষ যে কোনো বয়সে বিয়ে করছে। কে কাকে বিয়ে করছে তার কোনো বাছবিচার নেই। প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থকড়ি, খ্যাতি ও সুনাম রয়েছে- এমন ব্যক্তি যাকে খুশি বিয়ে করছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে কোনো কিশোরীকে বিয়ে করে তিনি হয়তো ‘আত্মতুষ্টি’ বোধ করছেন। অথচ কখনো চিন্তা করে দেখেননি যে, তিনি যাকে বিয়ে করলেন সে হয়তো আবেগ কিংবা জেদ অথবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই বৃদ্ধকে বিয়ে করেছে।

বয়সের আকাশ-পাতাল পার্থক্য নিয়ে যে দম্পতি সংসার জীবন শুরু করে, তাদের ভালোবাসা কিছু দিন পর কর্পূরের মতো উবে যায়। এই ধরনের দম্পতির অভিভাবকরা তখনই বুঝতে পারেন অসম বয়সে বিয়ের যন্ত্রণা কেমন। আকাশ-পাতাল বয়সের পার্থক্য নিয়ে বিয়ে করা বাস্তবিক অর্থে একটি সামাজিক সমস্যা। আইনের দৃষ্টিতে ১৮ বছর বয়সের একজন সাবালিকা যে কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে পারে- সেটা আইনগত কোনো দোষের বিষয় নয়। তবে সমস্যা হচ্ছে, সমাজে এদের নিয়ে মানুষ অস্বস্তিতে থাকে। তাদের উপস্থিতি হাস্যরস কিংবা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সবার আগে মানুষ তাদের দিকে দৃষ্টি দেয়। তাদের জীবনযাপনের শেষ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না’- এই বাক্যটি অসম বিয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রয়োজ্য। সে কারণে বিয়ের একটা বয়স নির্ধারণ করা দরকার। আমাদের সমাজে এখন হরহামেশা অসম বয়সে বিয়ের ঘটনা ঘটছে। অতি সম্প্রতি রাজধানীর একটি নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য ওই প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। ছাত্রীর বয়স ১৮ হওয়ায় আইন অনুসারে সে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার অর্জন করেছে।

দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে তার জীবনসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তার থাকলেও বিয়ের মতো জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তার নিজের ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি। ওই ছাত্রী যাকে বিয়ে করেছে তার বয়স ৬০-৬৫ বছরের কম হবে বলে মনে হয় না। প্রকৃত অর্থে এই বয়সে দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যাওয়ার মতো শারীরিক গঠন তার নেই। এই বিয়ে নিয়ে ছাত্রীর বাবা ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করলেও এখানে আদালতের কোনো কিছু করার ছিল না। কেননা, ওই ছাত্রী তাকে স্বামী বলে স্বীকার করে স্বামীর সঙ্গে সংসার করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আদালত ওই ছাত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তাকে স্বামীর সঙ্গে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। বাস্তব পরিস্থিতিতে ওই ছাত্রীর বাবা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। তিনি ১৮ বছর ধরে তার মেয়েকে লালন-পালন এবং তার ব্যয়বহুল শিক্ষাজীবন চালিয়ে আসছেন।

কন্যা সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দেয়ার মতো স্বপ্ন প্রতিটি অভিভাবক দেখেন। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সন্তানের কল্যাণে যেভাবে ত্যাগ স্বীকার করা দরকার, তা একজন অভিভাবক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করেন। তার স্বপ্ন থাকে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে জীবনের শেষ সময়টা কাটিয়ে দেবেন। অথচ একজন কন্যা যদি তার পিতার চেয়েও বেশি বয়সি লোককে তার স্বামী হিসেবে বেছে নেয়, তাহলে এর ফলাফল যে ভালো হবে না, তা দেখার জন্য খুব একটা বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। বয়সের কারণে মানুষের জীবন-আচরণের পরিবর্তন ঘটে। অসম বয়সে বিয়ে করার পর সাময়িক সময়ের জন্য নিজেকে ‘সুখী’ মনে হলেও, কিছু দিন পর তার দুঃখজনক পরিণতি মানুষ দেখতে পায়। আমাদের দেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব কন্যাসম পাত্রীকে বিয়ে করে পরবর্তী সময়ে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তারা আমাদের সমাজে নন্দিত হলেও একটি সময়ে এসে নিন্দিত হয়েছেন। তাদের এই বিষয়টি মানুষ দৃষ্টান্ত হিসেবে মনে রাখে, সতর্ক হয়- সতর্ক করে। মেয়ের স্বামীর বয়স যদি শ্বশুরের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে শ্বশুরের সঙ্গে জামাতার সম্পর্ক কেমন হবে, তা সহজেই অনুমেয়। পরবর্তী সময়ে যা সমাজ এবং বাস্তব জীবনে মারাত্মক বিপত্তি দেখা দেয়।

গণমাধ্যমে প্রায়ই বিয়ে নিয়ে নানা রকম মুখরোচক খবর প্রকাশ পায়। চাচির সঙ্গে ভাতিজার বিয়ে, মামির সঙ্গে ভাগনের বিয়ে, দাদার সঙ্গে নাতনির বিয়ে, পুত্রবধূর সঙ্গে শ্বশুরের বিয়ে কিংবা ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষকের বিয়ে- এরকম অসম বিয়ের ঘটনার পেছনে যাই হোক না কেন, সেটি পরিহারের চেষ্টা করা দরকার। যারা এই অসম বিয়ে করে, তারা একটা মোহ ও ঘোরের ভেতরে থাকে। তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে নিবৃত্ত করা গেলে জীবনের সর্বনাশ পরিণতি এড়ানো সম্ভব। এ ধরনের বিয়ে করার পর স্বামী-স্ত্রী কখনো কখনো একসঙ্গে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কেননা, তারা সমাজের হাসির খোরাক হয়ে পড়ে। লোকলজ্জা ও আত্মসম্মানবোধ যখন জাগ্রত হয়, তখন তারা বুঝতে পারে জীবনের কি সর্বনাশা সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে।

মানুষ আবেগময় জীবনযাপন করে, এটা ঠিক। তাই আবেগের বশীভূত হয়ে অনেকে এমনটি করে থাকে। আবার জেদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অনেকে অসম বয়সি কাউকে বিয়ে করে। অর্থবিত্ত, পদপদবি ও সমাজে খ্যাতি রয়েছে- এমন কাউকে বিয়ে করে অন্য উদ্দেশ্য হাসিল করার কোনো অর্থ নেই। মানুষ বিয়ে করে মূলত তার দাম্পত্য জীবনটাকে শান্তিময় করতে এবং সন্তানের পিতামাতা হতে। অথচ অসম বয়সে বিয়ের কারণে কেউ যদি সেই লক্ষে পৌঁছাতে না পারে, তখনই তার জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। মানুষ যখন অজ্ঞাতসারে ভুল পথে আগায়, তখন তাকে বাধা দেয়া উচিত। তাকে অবহিত করা উচিত। এই ধরনের পরিণতি সম্পর্কে তাকে সচেতন করা উচিত। তা না হলে সমাজ কলুষিত না হলেও দূষিত হবে। আইনের ধারাকে বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব হলেও দাম্পত্য জীবনকে শান্তিময় করা দুরূহ হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত